

‘অগ্রগামী ট্রেডার্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচটি বৈদ্যুতিক পণ্য কিনেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এই কেনাকাটা হয়। পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বরাবর বিল জমা দিয়ে অর্থও তোলা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ‘অগ্রগামী ট্রেডার্স’ নামে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্বই নেই। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা হিসেবে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ সায়েদাবাদ এলাকার যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এ ছাড়া এই একই ঠিকানা ও ফোন নম্বর ব্যবহার করে শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম বদল করে পণ্য কেনার ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরনের কেনাকাটার একাধিক ভুয়া রসিদের সন্ধান মিলেছে।
অন্যদিকে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বুকে লাগানোর ‘শোক দিবসের’ ব্যাজ বানাতে গিয়ে পকেট ভারী করার ঘটনাও ঘটেছে। ২০২৩ সালে শোক দিবসের জন্য কালো ব্যাজ বানানোর ১৫টি বিলে ৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা পাস করানো হয়। বিলে ব্যাজ দেখানো হয় সাড়ে ৩ হাজার। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫০ জন। গুলিস্তানের যে দোকানের নামে বিল করা হয়েছে, সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই দোকান এসব ব্যাজ তৈরি করেনি। প্রতিটি ব্যাজের মূল্য ১০০ টাকা করে ধরা হলেও বাস্তবে দাম আরও কম। আর কৌশলে এসব বিল-ভাউচার প্রতিটি ২৫ হাজার টাকার নিচে করা হয়েছে। কেননা, আইন অনুযায়ী বিল ২৫ হাজার টাকার কম হলে একজন উপসচিব একক ক্ষমতাবলে তা অনুমোদন করতে পারেন।
শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়; দরপত্রে কারসাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, সনদ জালিয়াতি, পণ্য না কিনেই বিল উত্তোলন, কম টাকায় পণ্য কিনে বেশি টাকায় বিল তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ, বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিয়ে কাগজ তৈরি করে বিল তোলা সংক্রান্ত বহু নথি কালবেলার হাতে এসেছে। জানা গেছে, এসব কার্যক্রম চালাতে গিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে রীতিমতো দুর্নীতির ‘মহারাজে’ পরিণত হয়েছেন পাঁচ কর্মকর্তা। বিভিন্ন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে কমিটি গঠন করে তদন্তও হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটি তাদের দোষ খুঁজে পেলেও শেষ পর্যন্ত এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার সবাইকে তদন্তের আওতায়ও আনা হয়নি।
এই পাঁচ কর্মকর্তা হলেন সাবেক সহকারী সচিব মো. ফয়জুল্লাহ বিশ্বাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান মোড়ল, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহীনুর ইসলাম ও উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলে অন্তত ৩ কোটি টাকার নিরীক্ষা আপত্তি নিষ্পত্তি হয়নি। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময় তাদের বিরুদ্ধে একাধিকবার দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দায়ের করা হলেও সরকারের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগে তারা বারবার পার পেয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাকিম ২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি দুদকে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন দুদক সচিব। পরে মন্ত্রণালয় দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু সেই কমিটি শুধু মো. ফয়জুল্লাহ বিশ্বাসের কেনাকাটা ও বিল-ভাউচার পরীক্ষা-নিরীক্ষা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে আনা অর্থ আত্মসাতের তিনটি অভিযোগ সরাসরি প্রমাণ হলে তাকে সহায়তাকারী হিসেবে সাবেক একজন উপসচিবের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে এবং কমিটির কার্যপরিধির বাইরে যে বিষয়গুলো ছিল, সেগুলোর বিষয়ে আলাদা তদন্ত করতে কমিটি সুপারিশ করে। তবে ফয়জুল্লাহ বিশ্বাসের আর্থিক অনিয়মের সহযোগী শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তাদের কৌশলে দায়মুক্তি দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আত্মসাতের টাকা পাঁচ কর্মকর্তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতেন। এ ক্ষেত্রে আসাদুজ্জামান মোড়ল ২০ শতাংশ, সাইফুল ইসলাম ১০ শতাংশ, শাহীনুর ইসলাম ১০ শতাংশ, উপসচিব ২০ শতাংশ এবং ফয়জুল্লাহ বিশ্বাস নিতেন ৪০ শতাংশ টাকা। তাদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের প্রটোকল অফিসার ছিলেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয়দের নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। ‘স্বপ্নিল’ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে ‘৪২/সি মনেশ্বরী রোড, হাজারীবাগ, ঢাকা’ উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তবে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান বা ঠিকানার অস্তিত্ব নেই। অথচ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে প্রচুর কেনাকাটা হয়েছে। অথচ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাকে তদন্তের আওতায় আনা হয়নি।
এদিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহীনুর ইসলাম ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৯৯-২০০১) ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ছাত্রলীগের পরিচয় ব্যবহার করে মন্ত্রণালয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের ভাই এপিএস সাহাবুদ্দিন, ভাতিজি শামীমা সুলতানা হৃদয় ও ভাগিনা ইয়াছিন আরাফাত পৃথিবী।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহীনুর ইসলাম ও আসাদুজ্জামান মোড়ল এসব অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন। শাহীনুর ইসলাম বলেন, ‘আমি শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি, তবে কোনো কেনাকাটার শাখায় আমি কখনোই যুক্ত ছিলাম না। কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় আমার কোনো ভূমিকা ছিল না। আমাদের মন্ত্রণালয়ে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে, তারা ষড়যন্ত্র করে আমার নাম জড়িয়েছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল, কিন্তু তদন্তে আমার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম বা সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই আমার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমি এসবের কোনো কিছুর সঙ্গেই যুক্ত নই।’
অন্যদিকে আসাদুজ্জামান মোড়ল বলেন, ‘আমি প্রশাসন শাখার কর্মকর্তা, কেনাকাটার কোনো শাখার সঙ্গে আমার কিংবা আমার ইমিডিয়েট বসের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের নাম কখনোই দুদকের তদন্তে আসেনি। তবে এটা ঠিক যে দুটি আলাদা তদন্ত হয়েছিল। দুজন উপসচিবের নেতৃত্বে তদন্তগুলো সম্পন্ন হয়, কিন্তু দুবারই তদন্তে আমাদের কোনো দোষ পাওয়া যায়নি। সেই তদন্তের রিপোর্ট বর্তমানে প্রশাসন শাখায় সংরক্ষিত আছে। আমি এসব অনিয়মের সঙ্গে একেবারেই সম্পৃক্ত নই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘এগুলো আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগের ঘটনা। তবুও বলব, যারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের কারও স্বপদে থাকার সুযোগ নেই। তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়গুলো আমার কাছে আসেনি। আমার সময় যেসব তদন্ত হয়েছে, সবগুলো আমি খেয়াল রেখেছি। যদি কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
মন্তব্য করুন