আর মাত্র সপ্তাহের অপেক্ষা। তার পরই ট্রেনের হুইসেলের মিতালি হবে সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে। বলছি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আর দেশের বৃহত্তম পর্যটন নগরী কক্সবাজারের কথা। সপ্তাহ ঘুরলেই সেখানে যাবে ট্রেন। এ খবরে উচ্ছ্বসিত পর্যটক থেকে শুরু করে সবাই। ভ্রমণপিপাসু মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি রেল সংযোগ। অবশেষে সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। নগরের যাত্রী নিয়ে ঝিনুকের শহরে যাচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রেন।
আগামী ১১ নভেম্বর দোহাজারী থেকে এ রেলপথ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিন রামুতে সুধী সমাবেশ করবেন প্রধানমন্ত্রী। পরে মহেশখালীতে উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন। আর ১ ডিসেম্বর থেকে যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি চলাচল করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বনিম্ন ৫১৫ এবং সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩৬ টাকা। অর্থাৎ বাসের চেয়ে কম ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ থাকবে। শুরুতে এ রুটে ঢাকা থেকে প্রতিদিন চলবে এক জোড়া আন্তঃনগর।
প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন কালবেলাকে বলেন, আগামী ৭ নভেম্বর রেলমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রায়াল রান হবে। ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে আসবেন। আইকনিক স্টেশন দেখবেন এবং ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করবেন।
এর আগে প্রকল্পটি ১২ নভেম্বর উদ্বোধনের কথা ছিল। রেল মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. সিরাজ-উদ-দৌলা খান বলেন, উদ্বোধনের সময় একদিন এগিয়ে আনা হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন প্রস্তুতিও চলছে। এর আগে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি সাপেক্ষে ১২ নভেম্বর উদ্বোধন হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানান।
এদিকে, কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে আইকনিক স্টেশন। এই স্টেশন নিয়ে আগ্রহের যেন শেষ নেই। আধুনিক এই স্টেশনে যাত্রীদের জন্য রয়েছে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। আছে থাকার ব্যবস্থাও।
রেলওয়ে মহাপরিচালকের কার্যালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, দিনে একটি ট্রেন ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ১০টায় যাত্রা করে বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রাম স্টেশনে বিরতি দিয়ে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে কক্সবাজারে পৌঁছবে। আবার কক্সবাজার থেকে দুপুর ১টায় যাত্রা করে রাত ৯টা ১০ মিনিটে ঢাকায় ফিরবে। ফিরতি পথেও চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করবে। মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে। সব মিলিয়ে ঢাকা থেকে ককক্সবাজার যেতে সময় লাগবে আট ঘণ্টা।
ট্রেনটির ছয়টি নাম প্রস্তাব করেছে রেলওয়ে। এগুলো হলো–‘প্রবাল এক্সপ্রেস’, ‘হিমছড়ি এক্সপ্রেস’, ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’, ‘ইনানী এক্সপ্রেস’, ‘লাবণী এক্সপ্রেস’ ও ‘সেন্টমার্টিন এক্সপ্রেস’। তবে নাম চূড়ান্ত করবেন প্রধানমন্ত্রী।
ট্রেনে দুটি খাবার বগি, একটি পাওয়ার কার, তিনটি এসি কেবিন, পাঁচটি এসি চেয়ার, ছয়টি শোভন চেয়ার এবং একটি নন-এসি ফার্স্ট সিট বগি থাকবে। ঢাকা থেকে যাত্রার সময় আসন সংখ্যা হবে ৭৯৭। ফিরতি পথে ৭৩৭টি। রেলসূত্রের ভাষ্য, আপাতত ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের তূর্ণা নিশিথার বগি দিয়ে চালানো হবে ট্রেনটি। তূর্ণা নিশিথায় বিকল্প রেক দেওয়া হবে।
ঢাকা-কক্সবাজার সর্বনিম্ন ৫১৫, সর্বোচ্চ ভাড়া ২০৩৬ টাকা রেলওয়ের বাণিজ্যিক শাখা জানিয়েছে, চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কক্সবাজারের প্রকৃত দূরত্ব ১৫০ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। তবে রেলওয়ের নতুন নিয়ম অনুযায়ী ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সেতুর জন্য অতিরিক্ত ভাড়া ও দূরত্ব (পয়েন্ট চার্জ) নির্ধারণ করছে। ওই রুটে সাতটি সেতুর জন্য বাড়তি ৫৪ কিলোমিটারের ভাড়া আরোপ করা হয়েছে।
বাড়তি পয়েন্ট চার্জ যুক্ত করে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রুটে বাণিজ্যিক দূরত্ব ২০৫ কিলোমিটার ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। এর সঙ্গে
ঢাকা-চট্টগ্রামের ৩২১ কিলোমিটারের বাণিজ্যিক দূরত্ব বিবেচনায় ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হবে। অর্থাৎ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার সর্বমোট ৫৫১ কিলোমিটার বাণিজ্যিক দূরত্ব ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, নন-এসি অর্থাৎ শোভন চেয়ারে ৫১৫ টাকা ও এসি সিটে ৯৮৪ টাকা ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। সে হিসাবে, এসি সিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ ভাড়া পড়বে ১ হাজার ১৩২ টাকা। আর এসি কেবিনে ১ হাজার ৩৬৩ এবং এসি বার্থে ভাড়া পড়বে ২ হাজার ৩৬ টাকা।
তবে প্রকল্পটি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে সংশয়-শঙ্কা ও চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্তৃপক্ষের শঙ্কা, নতুন রেললাইনটির বড় একটি অংশ বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত সাতকানিয়া-লোহাগাড়া-চকরিয়া ও কক্সবাজার এলাকায়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ২০১৪-১৫ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তির শঙ্কা। সঙ্গে লাইনের যন্ত্রাংশ চুরির ভয়। এজন্য নতুন রেললাইনের নিরাপত্তায় দুটি থানা এবং ছয়টি ফাঁড়ি নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ে পুলিশ জানায়, এই প্রকল্পের আওতায় আলাদা পুলিশ স্টেশন ও ফাঁড়ির জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। আপাতত জেলা পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীসহ রেল প্রশাসন নিরাপত্তার বিষয়গুলো মনিটরিং করবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তা জানান, ২০১৪-১৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনা ঘটে। আমরা চাই, সে তিক্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক। এমন হলে রেললাইন নিরাপদ রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
রেলওয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হাসান চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, আলাদা পুলিশ স্টেশন ও ফাঁড়ির জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। এখনো অনুমতি পাইনি। তারপরও জেলা পুলিশ ও রেল প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা সমন্বয় করে কাজ করবেন।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন, আনন্দের সঙ্গে কিছু সংশয়ও কাজ করে। তা হলো—রেললাইনের যন্ত্রাংশ চুরি, স্লিপার খুলে নেওয়া এবং স্টেশনগুলোকে অক্ষত রাখা। লাইন অক্ষত রাখাও চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে স্থানীয়সহ সবার আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি। কারণ এটি দেশের জাতীয় সম্পদ।
প্রসঙ্গত, প্রকল্পটি ২০১০ সালে অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প সংশোধনে ব্যয় বেড়ে দাড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে দেশের ৪৫তম জেলায় যুক্ত হচ্ছে রেল লাইন।