

বহু আলোচনা, মতবিরোধ এবং সমালোচনার পর শেষ পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে কপ-৩০ সম্মেলন শেষ হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা হলো-৮০টিরও বেশি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমানোর জন্য একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করলেও তা চূড়ান্ত চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অনেকেই মনে করছেন, এতে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলোর মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের কারণে আলোচনা একদিন বাড়াতে হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং পরিবেশগত অগ্রাধিকারের মধ্যে সমন্বয় করা কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে, সেখানে শুধু বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে- যা বিশ্বের জলবায়ু অগ্রগতির ক্ষেত্রে গভীর ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনের প্রতিফলন।
প্রতি বছরের মতোই ইউএনএফসিসিসির আওতায় কপ-৩০ অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের সম্মেলন ৬ থেকে ২২ নভেম্বর ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ১৯৪টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। শিল্পখাত ও কৃষিখাত থেকে শতাধিক লবিস্টও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এটি দেখায়, জলবায়ু নীতিনির্ধারণে বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রভাব কত দ্রুত বাড়ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং সান মারিনো এই সম্মেলনে অংশ নেয়নি।
আমাজন নদীর মোহনায় আয়োজিত সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো এবং জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় জাতিসংঘের বিদ্যমান কাঠামোকে শক্তিশালী করা। এ বছরের আলোচনায় ৩টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়-১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা সীমাবদ্ধ রাখা, নতুন জাতীয় জলবায়ু প্রতিশ্রুতি দাখিল এবং কপ-২৯-এ করা জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনা। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসহ ৮০টিরও বেশি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর একটি স্পষ্ট ও সময়বদ্ধ পরিকল্পনা দাবি করে।
তাদের মতে, এ ধরনের রোডম্যাপ কপ-৩০-এর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বড় অর্থনীতি ও তেল-গ্যাস রপ্তানিকারক দেশগুলোর বিরোধিতায় সেই দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো- চূড়ান্ত চুক্তি থেকে ‘জীবাশ্ম জ্বালানি’ শব্দটাই বাদ দেওয়া হয়েছে যা কপ ইতিহাসে প্রথম। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো বা এর ব্যবহার ধাপে ধাপে হ্রাস করার কোনো উল্লেখও চুক্তিতে রাখা হয়নি। অনেক অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধি ও পরিবেশবাদী কর্মী এতে গভীর হতাশা প্রকাশ করেন।
তাদের মতে, জীবাশ্ম জ্বালানি বাদ দেওয়া মানে জলবায়ু সংকটের মূল কারণকে এড়িয়ে যাওয়া। অন্যদিকে কিছু তেল উৎপাদনকারী দেশ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। তাদের ভাষ্য, শক্তি রূপান্তরের গতি ও দিকনির্দেশনা ঠিক করার সার্বভৌম অধিকার তাদেরই থাকা উচিত। ফলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত কতটা গভীর।
জীবাশ্ম জ্বালানির রোডম্যাপ না পাওয়ার পেছনে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, কপ-২৮- এ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে যাওয়ার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা এখন অনেক দেশে রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। তেল-গ্যাসনির্ভর দেশগুলো মনে করছে, দ্রুত শক্তি রূপান্তর তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সৌদি আরব ও রাশিয়ার মতো প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর জন্য বাধ্যতামূলক কোনো ভাষা অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছে। কারণ তাদের অর্থনীতি মূলত তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি আলোচনায় নেতৃত্বের ঘাটতি তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া দেশগুলোর পাশে থাকে, ফলে তাদের অনুপস্থিতিতে তেলনির্ভর দেশগুলোর অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়।
জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমানোর রোডম্যাপ না থাকার প্রভাব গভীর হতে পারে। প্যারিস চুক্তিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো প্রয়োজন। কিন্তু কপ-৩০- এর চুক্তিতে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকায় অনেক দেশ চাপ অনুভব নাও করতে পারে। ফলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রচেষ্টা ধীর হতে পারে, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কম গতিতে বাড়তে পারে এবং জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। কিছু দেশ হয়তো শক্তি দক্ষতা বাড়ানোর মতো ‘সহজ’ উদ্যোগে আগ্রহী হবে, কিন্তু বিদ্যুৎ, পরিবহন ও শিল্পে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। এতে ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্য আরও দুরূহ হয়ে উঠবে। বিনিয়োগ ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে পারে। সবুজ ও টেকসই বিনিয়োগে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা বুঝতে অসুবিধায় পড়বে কোন দেশ সত্যিই কার্বন কমাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এতে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলো এটাকে উৎসাহ হিসেবে নিয়ে উৎপাদন বাড়াতে পারে। এর ফলে বৈশ্বিক নিঃসরণ কমার বদলে বাড়তে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেখানে জলবায়ুর ক্ষতি বেশি ভোগ করে, সেখানে উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে এগিয়ে থাকবে- এভাবে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমানোর রোডম্যাপ না থাকায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। জলবায়ু দুর্যোগ দারিদ্র্য, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও নগরব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে SDG-৭, SDG-৮, SDG-১০ এবং SDG-১১ অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ পিছিয়ে গেলে পরিচ্ছন্ন শক্তির প্রাপ্যতা বাড়ানোও কঠিন হবে।
তবে কপ-৩০-এ কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। ‘Just Transition Mechanism’-এ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যা নিশ্চিত করে যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সবুজ শক্তিতে রূপান্তর হবে ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। উচ্চ-কার্বন শিল্পে কর্মরত শ্রমিক ও সম্প্রদায়কে পিছিয়ে না রেখে রূপান্তরের পথ তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য। পাশাপাশি প্রায় ৯০টি দেশ ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর রোডম্যাপের পক্ষে অবস্থান নেওয়া আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইচ্ছার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। Belém Mission to 1.5 এবং Global Implementation Accelerator-এর মতো উদ্যোগ ভবিষ্যৎ বাস্তবায়নে কাঠামোগত সহায়তা দেবে। জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাস্তবতা, যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা ও চরম আবহাওয়ায়। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো জরুরি। একই সঙ্গে সব দেশকে অভিযোজন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে, টেকসই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং উন্নত-অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞান ও অর্থায়ন বিনিময় আরও শক্তিশালী করতে হবে। ন্যায্য ও টেকসই শক্তি রূপান্তরের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও পৃথিবীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনই সময়ের দাবি।
লেখক : ড. মুহাম্মদ বদরুল হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন