রেলওয়েতে তিন ধাপে চলছে বিনা টিকিটের যাত্রী বাণিজ্য। এই অপকর্মে প্রথম ধাপে যুক্ত আন্তঃনগর ট্রেনের অ্যাটেনডেন্টস। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তারা যাত্রীদের তুলে দেন রেল পুলিশের কাছে। রেল পুলিশ বিভিন্ন স্টেশনে থাকা চেকারদের বলে বিনা বাধায় গেট পার করে দেন। এ থেকে আয়ের অর্থ ভাগবাটোয়ারা হয় সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট চক্রের মধ্যে। কালবেলার এ-সংক্রান্ত অনুসন্ধানে এসব চিত্র দেখা গেছে।
পূর্ব ও পশ্চিম দুই অঞ্চল ঘিরে দেশে রেলওয়ের কার্যক্রম। রেলের বাণিজ্যিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নানামুখী তৎপরতার পরও টিকিট ছাড়া যাত্রীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। আন্তঃনগর ট্রেনের চেয়ে লোকাল ট্রেনে এমন যাত্রী অনেক বেশি। রেলওয়ের উদাসীনতা ও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে প্রতিবছর দুই কোটির বেশি যাত্রী বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করেন। এতে প্রতিবছর অন্তত ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ভারী হচ্ছে বাৎসরিক লোকসানের পাল্লা। এ অবস্থায় রেল কর্মকর্তারা বলছেন, লোকসান কমাতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাড়ানো হবে জনবল। বিনা টিকিটে যাত্রী ভ্রমণের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
রেল কর্মকর্তারা বলছেন, পুরোনো রেল আইনের সংস্কার না হওয়ায় আদায় করা যাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত জরিমানা। জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক কালবেলাকে বলেন, জনবল, সচেতনতা বাড়ানো ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে রেলে বিনা টিকিটের যাত্রী ভ্রমণ কমানো সম্ভব হবে না।
রেলওয়ে পশ্চিম বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ২২ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছর সাড়ে চার মাসে বিনা টিকিটের যাত্রী সংখ্যা ১৫ লাখ ৮ হাজার ১৯৫। তাদের থেকে ভাড়া ও জরিমানা বাবদ আদায় করা হয়েছে ১১ কোটি ৭৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে বছরে রেলের দুই অঞ্চলে বিনা টিকিটের যাত্রী ২০ লাখ। রেলের কর্মকর্তা বলছেন, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা সম্ভব না হওয়ায় ১০ গুণের বেশি আছে হিসাবের বাইরে। সব মিলিয়ে বছরে ২ কোটির বেশি বিনা টিকিটের যাত্রী রেল ভ্রমণ করছেন।
রেলের ঢাকা বিভাগীয় বাণিজ্যিক দপ্তর থেকে জানা যায়, তিন স্তরের চেকিং ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়েই ট্রেনে উঠছে টিকিট ছাড়া যাত্রী। দেশের সবচেয়ে যাত্রীবহুল ব্যস্ত স্টেশন হলেও কমলাপুরে টিকিট কালেক্টর মাত্র তিনজন। ফলে ঢাকার বাইরে থেকেও ঢাকায় আসা যাত্রীরা টিকিট চেকারের চোখ ফাঁকি দিয়েই পার হয়ে যাচ্ছেন। আবার ১৪ বগির একটি ট্রেনে চেকার মাত্র দুই থেকে তিনজন, এতে বাড়ছে বিনা টিকিটের যাত্রী।
সরেজমিন ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অন্তত ১০টি আন্তঃনগর ও ১০টি লোকাল ট্রেনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি কামড়ায় দায়িত্ব পালন করা অ্যাটেনডেন্টরা প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে বিনা টিকিটের যাত্রীদের রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আরএনবি সদস্যদের হাতে তুলে দেন। আরএনবি সদস্যরা স্টেশনের চেকারদের বলে বাইরে যাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করেন। বিশেষ করে রাতে ও ভোরের ট্রেনগুলোতে এই প্রবণতা অনেক বেশি, যা প্ল্যাটফর্মের সিসিটিভি ফুটেজে চেক করলেই বের করা সম্ভব।
একাধিক আরএনবি ও অ্যাটেনডেন্ট সদস্য কালবেলাকে বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে বেতনে সংসার চালানো কষ্টকর। তাই মাঝেমধ্যে যাত্রী পরিবহন করা হয়। এ থেকে আয়ের অংশ কয়েকটি ভাগে বিতরণ করার কথা জানান তারা। তারা বলেন, অনেক সময় আসন ফাঁকা থাকে। নির্দিষ্ট দূরত্বের আগে যাত্রীরা নেমে যান। অথবা অবিক্রিত টিকিটে চুক্তিতে যাত্রী পরিবহনের কথা জানান তারা। অনেকেই বিনা টিকিটে দাঁড়িয়ে ভ্রমণের সুযোগ নেন। মূলত এমন যাত্রীদের থেকেই ভাড়া আদায় করা হয়, যা রেলওয়ের রাজস্ব খাতে যায় না। এর মধ্যে টিটিইরাও জড়িত থাকার কথা জানান তারা। যাত্রীরা জানিয়েছেন, ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে সব ধরনের আসনসহ কেবিন পর্যন্ত চুক্তিতে মেলে।
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আরএনবি ঢাকার কমান্ডেন্ট শহীদ উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, আমাদের সদস্যরা বিনা টিকিটের যাত্রীদের নিরাপদে স্টেশন থেকে বের করে দেওয়ার কাজে যুক্ত থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় এক হাজার টিকিট চেকার দরকার হলেও আছে মাত্র ১২০ জন। এমন তথ্য জানিয়ে ঢাকা বিভাগের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির কালবেলাকে বলেন, তাদের কাছ থেকে ২০০৭ সালে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বিচারিক ক্ষমতা। ফলে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা। তবে আইন সংশোধন করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অনেকেই চোখ ফাঁকি দিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের চেষ্টা করেন। যেসব স্টেশন সবদিক থেকে ফাঁকা, সেখানে টিকিট ছাড়া যাত্রীদের আটকানো কষ্ট। প্রতি ১০ জনে কমপক্ষে একজন টিকিট ছাড়া যাত্রী পাওয়ার কথাও জানান তিনি।
এসব স্বীকার করে রেলওয়ে মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানান, সমস্যা সমাধানে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হবে টিকিট চেকার ও কালেক্টর। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করব।
ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ বিন সারোয়ার কালবেলাকে বলেন, টিকিটবিহীন যাত্রী অনেক পাওয়া যায়। ফাঁক-ফোকর গলিয়ে কিছু যাত্রী বেরিয়ে যেতে পারে। এজন্য লোকবল সংকটের কথা জানান তিনি।
‘রেলওয়ে জেনারেল ম্যানেজার ওয়েস্ট-বাংলাদেশ রেলওয়ে’ ফেসবুকে পেজে নিয়মিত বিভিন্ন ট্রেনের অভিযানে বিনা টিকিটের যাত্রীদের পরিসংখ্যান ও জরিমানার চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা গেছে, সর্বশেষ ৩ নভেম্বর রাজশাহী-চিলাহাটি পর্যন্ত বরেন্দ্র এক্সপ্রেসে ১৬২ জন বিনা টিকিটের যাত্রী থেকে ২৪ হাজার ৫১৫ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ২ নভেম্বর বনলতা এক্সপ্রেসে ঢাকা-রাজশাহী ১৭৫ জন বিনা টিকিটের যাত্রী থেকে সাড়ে ৯৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। ১ নভেম্বর রাজশাহী-ঢাকা পথে বনলতা এক্সপ্রেসে ৫০ জন টিকিট ছাড়া যাত্রী থেকে ১৬ হাজার ৭৭০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
এর আগে গত ২০ অক্টোবর টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসে বিনা টিকিটের ৬৪ যাত্রীকে ১২ হাজার ৪৬০ টাকা, ১৫ অক্টোবর ঢালারচর এক্সপ্রেসে ইশ্বরদী বাইপাস থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ৬৪ যাত্রী থেকে ৭ হাজার ৬৩০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। একই দিন খুলনা থেকে ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ৬৫ জন বিনা টিকিটের যাত্রীকে ১২ হাজার ৮১৫ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ৯ অক্টোবর ধূমকেতু এক্সপ্রেসে ৬ হাজার ৮৫০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয় ২৪ জন টিকিট ছাড়া যাত্রীর থেকে। ৫ অক্টোবর সিল্কিসিটি ট্রেনে বিনা টিকিটের যাত্রী পাওয়া যায় ৭৫ জন। তাদের থেকে জরিমানা আদায় হয় ১৪ হাজার ৭০০ টাকা। ৪ অক্টোবর পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে বিনা টিকিটের ২১ যাত্রী থেকে ৬ হাজার ৩৮০ টাকা আর্থিক জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর বেনাপোল এক্সপ্রেসে ৪২ জন টিকিট ছাড়া যাত্রী থেকে ৬ হাজার ৬৮০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এমন চিত্র প্রতিনিয়তই দেখা মেলে।
রেলওয়ের পশ্চিমের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার কালবেলাকে বলেন, প্রতিদিন অভিযান চালালেই কমবেশি টিকেট ছাড়া যাত্রী মেলে। এটা খুবই দুঃখজনক। সবাই টিকিট করে ট্রেন উঠলে রেলওয়ের আয় বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন কালবেলাকে বলেন, বিনা টিকিটের যাত্রী আগের চেয়ে কমলেও বছরে এই সংখ্যা যেমন অনেক, তেমনি আর্থিক দিক বিবেচনায় লসও কম নয়। বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে সমাধানের চেষ্টা করছি।