দেশে স্বর্ণ শিল্পে বিনিয়োগ করার মতো সামর্থ্যবান উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বিদেশি উদ্যোক্তারা। আবার অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও স্থাপিত হয়েছে রিফাইনারি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশেই স্বর্ণের কাঁচামাল উৎপাদন বা স্বর্ণ পরিশোধন করার মতো উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু সুপারিশ কার্যকর না করায় এখনো স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়নের আগের চরিত্রেই থেকে গেছে দেশের জুয়েলারি খাত। নীতিসহায়তা দেওয়ার বিষয়েও ঘটেনি সদিচ্ছার প্রতিফলন। এ কারণে রপ্তানি সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ পেতে দীর্ঘসূত্রতা দিন দিন বাড়ছে। খুলছে না স্বর্ণ রপ্তানির সোনালি দুয়ার।
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, স্বর্ণ নীতিমালা এবং সবশেষ রপ্তানি নীতি আদেশ ২০২১-২৪-এর মধ্যেও কিছু কৌশলী বৈষম্য থেকে গেছে। স্বর্ণ নীতিমালায় হরেক নীতি সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হলেও রপ্তানি নীতি আদেশে জুয়েলারি শিল্পকে সরকারের অগ্রাধিকার বিবেচনার ১৪ খাতের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়নি। এটি স্থান পেয়েছে ১৮ শিল্প খাতের (বিশেষ উন্নয়নমূলক খাত) একটি হিসেবে। এ কারণে স্বর্ণালংকার উৎপাদন, সরবরাহ এবং রপ্তানি ভিত্তি সুসংহত নয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। অথচ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিলে স্বর্ণ রপ্তানিতে অধিকতর সাফল্য অর্জন সম্ভব।
আরও দেখা গেছে, স্বর্ণ নীতিমালা ও রপ্তানি নীতি আদেশের বিশেষ উন্নয়নমূলক খাতের সুবিধা প্রায় অভিন্ন। উভয় নীতিমালাতেই জুয়েলারি শিল্পের জন্য আয়কর রেয়াত, কমপ্লায়েন্ট শিল্প স্থাপনে বিনা শুল্কে উপকরণ আমদানি ও বন্ড সুবিধা পাওয়ার কথা। এ ছাড়া সহজ শর্তে রপ্তানি ঋণ, পণ্যের মানোন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আছে পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ, এবং উৎপাদন ব্যয় সংকোচনের উদ্দেশ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সহায়ক শিল্প স্থাপনে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিধান।
সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন কবে নাগাদ হবে, তার সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। ফলে খাত-সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের আকুতি-মিনতিও কারও কানে পৌঁছায় না। বছর যায় বছর আসে; প্রতিবার বাজেট হয়, কিন্তু সদিচ্ছার অভাবে রপ্তানি সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত হয় না স্বর্ণ শিল্পে। তার প্রমাণ মেলে এ খাতের রপ্তানি চিত্রে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ১৯৯৫ সালে প্রথম রপ্তানি শুরু হওয়া এই খাতটি গত ২০২১-২২ অর্থবছর এসে মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ ৯০ হাজার ২০০ টাকার স্বর্ণালংকার, স্বর্ণের বর্জ্য, স্ক্র্যাপ, মেটাল ক্ল্যাড, সুইপিং কনট, অন্যান্য ধাতুসহ হ্যান্ড টুলস নেজ গ্রাজিয়ার হীরা পণ্য রপ্তানি করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ কালবেলাকে জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শুধু নীতিসহায়তার সুপারিশ করতে পারে। কার্যকরের দায়িত্ব অন্য বিভাগের। আর লিয়াজোঁ মিনিস্ট্রি হিসেবে রপ্তানির সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগ্রত করতেই স্বর্ণ নীতিমালা জারি এবং স্বর্ণের কাঁচামাল ও স্বর্ণ আমদানিকে বৈধতা দেওয়া হয়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই জুয়েলারিকে বিশেষ উন্নয়নমূলক খাতে রাখা হয়েছে। নিশ্চয়ই খাতটি আগামীতে অগ্রাধিকার তালিকায় উঠে আসবে।
এদিকে, বিদেশি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিউওয়াই রিসার্চ তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ২৮৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার মূল্যের স্বর্ণালংকার, স্বর্ণের বার ও রুপার অলংকার বিক্রি হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। এতে আরও পূর্বাভাস দিয়ে বলা হয়, ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই বাজার প্রতিবছর গড়ে ১২ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে। ফলে ওই সময় বাংলাদেশে স্বর্ণালংকার, স্বর্ণবার ও রুপা মিলিয়ে স্থানীয় বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ১০৯ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। আর বাজুস সূত্র বলছে, চলতি বছর (২০২৩) আমদানি করা স্বর্ণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে তার আর্থিক বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে হাতে তৈরি যে অলংকার হয়, তার প্রায় ৮০ শতাংশ বাংলাদেশ ও ভারতে উৎপাদিত। এ চাহিদার প্রায় পুরোটাই রপ্তানি করছে ভারত। ২০২১-২২ অর্থবছরে অলংকার রপ্তানিতে ভারতে আয় ছিল ৩৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখানেই আগামীর সম্ভাবনার বড় ক্ষেত্র দেখছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ খাতে দেশের হাজার হাজার দক্ষ কারিগর রয়েছেন। তারা ভারতসহ অনেক দেশে গিয়ে সুনামের সঙ্গে স্বর্ণালংকার শিল্পে কাজ করছেন। দেশেও এই উদ্যোগগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দরকার শুধু একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ উত্তম বণিক কালবেলাকে বলেন, এই উদ্যোগকে বাস্তবে রূপ দেওয়া গেলে দেশে জুয়েলারি রপ্তানিতে নতুন অধ্যায় রচনা হবে। দেশেই তখন কম দামে মিলবে জুয়েলারি পণ্য।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশে রিফাইনারি স্থাপনের মাধ্যমে স্বর্ণবার উৎপাদন এবং তা দিয়ে তৈরি স্বর্ণালংকার রপ্তানির বড় সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই পারে কার্যকর সমাধান দিতে।
বাজুস প্রেসিডেন্ট ও বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর বলেন, জুয়েলারি খাতের পণ্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য সংযোজন করা সম্ভব। সেটি জেনে ইতোমধ্যে ৩০০ থেকে ৪০০ উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এখন নীতি সহায়তা হিসেবে দরকার এই শিল্পের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা। এর পাশাপাশি যদি ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা মেলে, তাহলে জুয়েলারি খাত হবে দেশে আগামীর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প।
রপ্তানি সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগাতে এই খাতের উন্নয়নে সব ধরনের নীতিসহায়তা দরকার বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
মন্তব্য করুন