২০১৮ সালে ফেসবুকে ‘ইটিসি টেক বিডি’ নামে পেইজ খুলে ব্যবসা শুরু করেন রাজধানীর মিরপুরের তরুণ উদ্যোক্তা আমিন উদ্দিন। ব্যবসার প্রসারের জন্য বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে বুস্ট তথা বিজ্ঞাপন প্রচার বাবদ দেড় হাজার মার্কিন ডলারের বেশি খরচ করেন তিনি। তবে ২০২১ সালে একদিন হুট করেই ফেসবুক থেকে তার পেইজটি মুছে যায়। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় ১০ লাখ অনুসারী (ফলোয়ার) থাকা পেইজটি হারিয়ে চরম বিপাকে পড়েন এই উদ্যোক্তা। লোকসানের খাতায় চলে যায় বিনিয়োগ করা প্রায় ৫ লাখ টাকা।
এভাবেই বিভিন্ন সময় ফেসবুক পেইজ এবং গ্রুপ হারিয়ে বিপাকে পড়ছেন অনেক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। পেইজ ও ব্যবসার প্রসারে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাখ লাখ টাকা খরচ করার পর হঠাৎ একদিন সবকিছু হারিয়ে ফেলছেন তারা। উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বুস্টিং বা বিজ্ঞাপন খাতে আয় করলেও পেইজ হারানোর মতো ঘটনায় ফেসবুকের কোনো দায়বদ্ধতা দেখা যায় না। ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া বা সমাধান পান না। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কোনো কার্যালয় না থাকায় জোরালো কোনো পদক্ষেপও নেওয়া যায় না। অথচ বাংলাদেশের তুলনায় ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম হলেও পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় কার্যালয় পরিচালনা করছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। আরেক জনপ্রিয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গুগলের ক্ষেত্রেও প্রায় একই অবস্থা।
আমিন উদ্দিনের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই শুধু ভুক্তভোগী হচ্ছেন, তা নয়। সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘রকমারি ডটকম’-এর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজ। ২০১২ সালে যাত্রা শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম রয়েছে দেশজুড়ে। অথচ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ফেসবুকে রকমারির পেইজটি মুছে গেছে।
রকমারি ডটকমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মাহমুদুল হাসান সোহাগ দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘২০১২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কয়েক কোটি টাকা ফেসবুকে বিনিয়োগ করেছি। পেইজটিতে ২৫ লাখের বেশি ফলোয়ার ছিল। অথচ হুট করেই সপ্তাহখানেক আগে পেইজটি ডাউন হয়ে যায়। ফেসবুক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কারণও জানানো হয়নি। আমরা নিজেরা এবং এইচটিটিপুল (বাংলাদেশে ফেসবুক মনোনীত বিজ্ঞাপনী এজেন্সি)-এর মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি। তারা শুধু ‘দেখছি, কাজ হচ্ছে’ এসব বলছে। আমরা পেইজটা ফিরে পেতে আশাবাদী। তবে এর মধ্যেই যে ব্যবসায়িক ক্ষতি হলো সেটা আসলে হিসাব করাও সম্ভব নয়।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফেসবুক, গুগল, গুগলের মালিকানাধীন ইউটিউব, আমাজন, নেটফ্লিক্সের মতো ডিজিটাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে একই অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে আয় করেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। যদিও এটি শুধু বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেনের হিসাব। বাংলাদেশের বাইরে থেকে অথবা নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে হওয়া লেনদেন হিসাব করলে এই অঙ্ক আরও বেশি বলে ধারণা তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের।
সর্বশেষ অর্থবছরে ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ভ্যাট দেয় ফেসবুক। এর মধ্যে ফেসবুক আয়ারল্যান্ড থেকে বাংলাদেশের হক ভট্টাচার্য দাস অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে ৩২ কোটি ৪৯ লাখ এবং আরেক প্রতিষ্ঠান ফেসবুক আয়ারল্যান্ড লিমিটেডের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করা হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশ থেকে ফেসবুকের মোট আয়ের পরিমাণ কমপক্ষে ২১৬ কোটি টাকা। অবশ্য ভ্যাট পরিশোধ ও রিটার্ন দাখিল করলেও এখন পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন দেয়নি ফেসবুক ও অন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো।
এ ছাড়া জার্মানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। আর মেটা বলছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর হিসাবে ভারত ও ফিলিপাইনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর হিসাবে বাংলাদেশ ফেসবুকের জন্য তৃতীয় বৃহত্তম বাজার। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে ফেসবুকের।
বাংলাদেশে এমন বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারী এবং মোটা অঙ্কের আয় থাকলেও কোনো কার্যালয় নেই ফেসবুকের। ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে কার্যালয় চালুর আশ্বাস দিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো অফিস খোলেনি ফেসবুক। তবে ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রথম বাংলাদেশ বিষয়ক একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় ফেসবুক; কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালন করেন সিঙ্গাপুরে থাকা প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে। বাংলাদেশে না থাকলেও পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ঠিকই কার্যালয় রয়েছে ফেসবুকের। অথচ পাকিস্তানে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ এবং শ্রীলঙ্কায় মাত্র ৮৬ লাখ ব্যবহারকারী রয়েছে ফেসবুকের। বাংলাদেশের থেকে কম ব্যবহারকারী থাকলেও দুটো দেশেই ফেসবুকের একটি করে কার্যালয় রয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক আয় নিলেও সাধারণ ব্যবহারকারী কিংবা উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের প্রতি কোনো দায়ই যেন অনুভব করেন না প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি কোনো পেইজ বা গ্রুপ ঠিক কী কারণে বন্ধ করা হচ্ছে, সে কারণটিও সুনির্দিষ্ট করে জানায় না ডিজিটাল মিডিয়াগুলো। অর্থ দিয়ে ‘ব্লু ব্যাজ’ নেওয়া ভেরিফায়েড আইডির ব্যবহারকারীরাও ফেসবুক থেকে এ বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না।
‘রিসাইকেল বিন’ নামে প্রায় ১৫ লক্ষাধিক সদস্যের ফেসবুকভিত্তিক কমিউনিটি গ্রুপের উদ্যোক্তা ছিলেন ফ্লোরিডা শারমিন সেতু। গ্রুপের ‘অ্যাডমিন’ হিসেবে ছিল তার নিজের ফেসবুক ভেরিফায়েড আইডি। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের অক্টোবরে গ্রুপটি খুলি। কমিউনিটি সার্ভিস হিসেবে গ্রুপটির পেছনে অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করেছি। কিন্তু হুট করেই গত জুলাইয়ে গ্রুপটি ফেসবুক বন্ধ করে দেয়। ই-মেইলে দেওয়া বার্তায় তারা শুধু লিখেছে, আমরা ‘কমিউনিটি গাইডলাইন’ ভঙ্গ করেছি, কিন্তু ঠিক কী ভঙ্গ করেছি সেটা নেই। টাকা দিয়ে ওদের সাবস্ক্রিপশন নিয়েছি। ফলে আমার আইডিতে ব্লু ব্যাজ আছে। সেই আইডির মাধ্যমে যোগাযোগ করলে তারা খুব দ্রুত উত্তর দেয়। কিন্তু প্রতিবার একই কথা, তারা বিষয়টি দেখবে। তবে প্রায় চার মাসেও গ্রুপটি ফিরে পাইনি।’
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেসবুকের এমন আচরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এফ-কমার্স ভিত্তিক নারী উদ্যোক্তারা। ১৪ লক্ষাধিক নারী সদস্যবিশিষ্ট উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের (উই) প্রতিষ্ঠাতা নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তারা স্বল্প পুঁজি নিয়ে ফেসবুক তথা এফ-কমার্স ব্যবসায় আসছেন। কিন্তু প্রায়ই শোনা যায়, কারও কারও পেইজ বা গ্রুপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফেসবুক ঘোষিত একজন কমিউনিটি লিডার হিসেবে আমরা তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে যোগাযোগ করি। কিন্তু আমাদের যাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তারা এখন আর সেখানে নেই। এর পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ‘বট’-এর ওপর নির্ভর করছে। এখন আমরা শুধু ‘সাপোর্ট ইনবক্স’-এ যোগাযোগ করতে পারি যেখানে এআই শুধু বলে যে, এমনটা হওয়ার কথা নয়। আমরা দেখছি।’
ফেসবুকের এসব আচরণকে স্বেচ্ছাচারিতা আখ্যা দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কালবেলাকে বলেন, ‘খুবই সহজভাবে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যায়। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিও তাদের নিতে হয় না। এই ব্যবস্থার ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে কারও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তর থেকে অনুমোদন নেওয়ার একটা বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। তাহলে সামাজিক মাধ্যমগুলো বুঝতে পারবে যে, বাংলাদেশ সরকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সহজ উপায়টা আমাদের অবলম্বন করতে দিচ্ছে না।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থা দায়ী। বাংলাদেশে অফিস না খুলে, নিবন্ধিত না হয়ে কোন লাইসেন্স নিয়ে কীভাবে তারা ব্যবসা করছে, বাংলাদেশ থেকে বাইরে টাকা নিয়ে যাচ্ছে সেটাই আমি জানি না; কারও কাছে স্পষ্ট না।’
ফেসবুককে জবাবদিহি এবং আইনের আওতায় আনতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে অনাপত্তিপত্র বা এনওসি দেওয়ার ক্ষমতা চেয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তরা যথাযথ মাধ্যমে আমাদের এ ধরনের বিষয় জানালে আমরা ফেসবুক কিংবা গুগলকে জানাই। তবে তারা আমাদের অনুরোধ শোনেন না বা কম শোনেন। তারা বাংলাদেশ থেকে টাকা নেওয়ার আগে আমাদের থেকে যেন ‘ক্লিয়ারেন্স’ নেয়, এ বিষয়টি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে আমরা অনুরোধ করেছি। এ ব্যবস্থায় গেলে তারা হয়তো আমাদের অনুরোধ শুনবে।’
বিটিআরসির এমন প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ‘এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো কাজ করছে। বিষয়টা চূড়ান্ত হলে বোঝা যাবে যে, তারা কী জবাব দেবে। প্রচলিত আইন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার বক্তব্য জানতে বাংলাদেশে তাদের জনসংযোগ এজেন্সির মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠানো হয়। তবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়নি বলে ওই এজেন্সির পক্ষ থেকে কালবেলাকে জানানো হয়।