তিনি রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে। বলেছিলেন, দিনে অন্তত ১৫ বার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নাকি বার্তা আদান-প্রদান হয়। হুমকি-ধমকিও দিয়েছিলেন সরকারকে। তার বক্তব্যের পর সাময়িক সময়ের জন্য ‘বাহবা’ও পেয়েছিলেন কারও কারও। সেই মিয়ান আরেফি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গাজীপুরের কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি। তাকে কেউ দেখতেও যান না।
কারাগার সূত্র জানায়, কারাগারে সাধারণ বন্দি ক্যাটাগরিতে রয়েছেন মিয়ান আরেফি। কারা কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা খাবার তাকে খেতে হচ্ছে। কারা সেলে সারা দিন পায়চারি করে আর টেলিভিশন দেখে তার সময় কাটে। দিনের বেশিরভাগ সময়ে বিষণ্ন থাকেন। কারও সঙ্গে খুব একটা কথাও বলেন না। তবে অন্য বন্দিদের কেউ তাকে চিনতে পারলে তারা ‘বিস্ময়ে’ তাকিয়ে থাকেন।
কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তারের পর হাই সিকিউরিটি কারাগারেই বন্দি রয়েছেন মিয়ান আরেফি। ওই কারাগারে নেওয়ার পর ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে একবার তাকে কারাগারে দেখতে যাওয়া হয়। এ ছাড়া তার কোনো স্বজন এ পর্যন্ত তাকে দেখতেও যাননি। মিয়ান আরেফি কারা কর্মকর্তাদের বলেছেন, ঢাকায় তার এক স্ত্রী থাকেন। কিন্তু তিনিও তার সঙ্গে দেখা করতে যাননি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, শুরুর দিকে কারাগারের খাবার খেতে মিয়ান আরেফির কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল। এখন মানিয়ে গেছেন। তিনি চাইলে নিয়ম অনুযায়ী নিজের টাকায় কারা ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনেও খেতে পারেন।
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা দৈনিক কালবেলাকে বলেন, মিয়ান আরেফির সঙ্গে দেখা করতে তার কোনো স্বজন কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তারা শুনেছেন, ওই বন্দির স্ত্রী ঢাকাতেই থাকেন, তিনিও যোগাযোগ করেননি। নিয়ম মেনে কেউ তার দেখা করতে চাইলে কারা কর্তৃপক্ষ তা করবে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক মিয়ান আরেফির প্রকৃত নাম মিঞা জাহিদুল ইসলাম আরেফি। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে সহিংসতায় আগেই শেষ হওয়ার পর তিনি রাজধানীর নয়াপল্টনে দলটির কার্যালয়ে হাজির হন। এরপর বিএনপির কয়েক নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। নিজেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা আর আমেরিকার ডেমোক্র্যাট দলের ন্যাশনাল কমিটির সদস্য পরিচয় দিয়ে তাকে বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতেও শোনা যায়। পাশাপাশি তিনি ধর্মীয় বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তখন তিনি দাবি করেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ পক্ষে।’ মিয়ান আরেফি বাইডেন ছাড়াও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং বাংলাদেশে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ‘প্রতিনিয়ত যোগাযোগের’ বিষয়েও কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, ‘মার্কিন সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিরোধীদের আন্দোলনকে সমর্থন করে।’ অবশ্য ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ওই দিনই জানানো হয় যে, দূতাবাসের কোনো ব্যক্তির বিএনপির কার্যালয়ে যাওয়ার বিষয়ে যে গুজব তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুল। ওই ভদ্রলোক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে কথা বলেন না। তিনি একজন বেসরকারি ব্যক্তি।
তবে ওইদিন ছড়িয়ে পড়ে যে বিএনপির মহাসমাবেশে সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন দেশের একাধিক নাগরিক বক্তব্য রাখবেন। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সহিংসতার কারণে তা সম্ভব না হওয়ায় বিকেলে বিএনপির কার্যালয়ে ‘মার্কিন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা’ সংবাদ সম্মেলন করবেন। সেদিন বিকেলে তিনি ইংরেজিতে বক্তব্য দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে চাউর হয় যে, ‘আমেরিকার পক্ষ থেকে’ বিএনপিকে সমর্থন জানানোর জন্য দলীয় কার্যালয়ে এসেছিলেন আরেফি। তবে ওইদিন রাতেই মিয়ান আরেফির আসল পরিচয় জানাজানি হলে অনেকটা হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
এদিকে উসকানিমূলক ও রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে মিয়ান আরেফি, সাবেক সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী এবং বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা করেন এক ব্যক্তি। ওই মামলায় ২৯ অক্টোবর ঢাকার বিমান বন্দর থেকে মিয়ান আরেফিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরে মামলার আসামি হাসান সারওয়ার্দীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিবির মতিঝিল বিভাগের একজন কর্মকর্তা দৈনিক কালবেলাকে জানিয়েছেন, ওই মামলায় দুই আসামি গ্রেপ্তারের পর কারাগারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে হাসান সারওয়ার্দীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং মিয়ান আরেফিকে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। পলাতক অপর আসামিকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।