সোমেশ্বরী, সুরমা ও পুরোনো সুরমা নদীর কিছু পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে অতিক্রম করছে। তিস্তাসহ দেশের বেশিরভাগ প্রধান প্রধান নদনদীর পানিও বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, লালমনিরহাট ও নীলফামারীর কিছু এলাকায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুশিয়ারা, মনু-খোয়াই ছাড়া প্রধান নদনদীগুলোর পানি বাড়ছে। ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার চলমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।
এদিকে বন্যা মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন নদীপাড়ের মানুষ। উঁচু জায়গা ও বাঁধের পাশে ঘর নির্মাণ করছেন কেউ কেউ। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের প্রস্তুতি। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী থাকার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কালবেলা প্রতিবেদক, ব্যুরো অফিস ও প্রতিনিধিদের
খবর।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশন আছে ১০৯টি। এর মধ্যে পানি বেড়েছে ৭৩টি স্টেশনের, কমেছে ৩৫টির, আর অপরিবর্তিত রয়েছে একটি। এদিকে বিপৎসীমার ওপরে উঠেছে তিনটি স্টেশনের পানি, এতে বন্যাকবলিত হয়েছে দুই জেলা।
গতকাল সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬ মিটার ওপর দিয়ে বইছে। একইভাবে নেত্রকোনার কমলাকান্দার সোমেশ্বরী নদীর পানি ২৪ মিটার এবং সুনামগঞ্জের দিরাই স্টেশনের পুরোনো সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার তিন মিটার ওপর দিয়ে বইছে।
বন্যার মুখে দাঁড়িয়ে রংপুর
গত তিন দিনের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা আর দুধকুমার নদীতে বাড়ছে পানি। পানি বাড়ছে, ঘাঘট ও যমুনেশ্বরী ও করতোয়া নদীতেও। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই অঞ্চলের সব নদনদীর পানি আরও বৃদ্ধি পাবে। তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
এদিকে নদীপাড়ের মানুষজন বন্যার আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ উঁচু জায়গায় ঘর তৈরি করছেন, কেউ বাঁধের ধারে ঘর তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেকে শুকনো খাবার প্রস্তুত রাখছেন। সেইসঙ্গে পশুপাখিকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও করছেন তারা।
গঙ্গাচরার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হাদী বলেন, নদীপাড়ের মানুষজনকে আগাম প্রস্তুতি নিতে বলেছি, আমরাও প্রস্তুত আছি। যে পরিমাণ বরাদ্দ পাই, তা পর্যাপ্ত নয়, শহরের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে অনেকে উপকৃত হবেন।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী গ্রামের আশরাফুল ইসলাম বলেন, পানি তো বাড়ছে তাতে সমস্যা নেই, কিন্তু পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে তিস্তার ভাঙন শুরু হবে। এটা থামাইতে হবে, ভাঙন থামাতে না পারলে কিছুই থাকবে না।
রংপুর জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন বলেন, বন্যা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রয়েছি।
নেত্রকোনার নিম্নাঞ্চল উঠছে পানি: কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে জেলার কলমাকান্দার উব্দাখালী, মহাদের, বৈঠাখালী, মঙ্গলেশ্বরী, গুমাই ও গণেশ্বরীর নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর, রাস্তা, বিদ্যালয় পানিতে তলিয়ে গেছে।
গতকাল সকাল ৬টার দিকে ওই নদীর কলমাকান্দা ডাকবাংলো পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া উপজেলার বাহাদুরকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাইজপাড়া, খলা-২, বড়খাপন, চৌহাট্টা, বাউসারী, হাইলাটী, রিকা, পোগলা, ভাটিপাড়াসহ প্রায় ৬০টি বিদ্যালয়ের মাঠে পানি ঢুকেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শহিদুল ইসলাম জানান, সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। জরুরি হটলাইন নম্বর খোলা হয়েছে। শুকনো খাবারসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যমুনায় বিলীন বিদ্যালয়
সিরাজগঞ্জের বেলকুচির খিদ্রচাপড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণিকক্ষ যমুনায় বিলীন হয়েছে। দুর্গম চরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৪০ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৮ সালে প্রায় ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একাডেমিক ভবন ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। ভাঙনরোধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিভিন্ন জায়গায় আবেদন দিয়েও শেষ রক্ষা হলো না বিদ্যালয়টির।
সুনামগঞ্জের ৯ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
সুনামগঞ্জে ছয়টি স্টেশনের মধ্যে তিনটি স্টেশনে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে সুরমার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত ১৮ জুন থেকে ছাতক স্টেশনে সুরমার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর স্টেশন এবং দিরাই স্টেশন। জেলার ৯ উপজেলার নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করছে। অনেক উপজেলায় রাস্তাঘাট তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়কের নিচু এলাকায় পানি সামান্য বেড়েছে। খাসিয়ামারা, চিলাই, চেলানদী, মরাচেলা ও সুরমা নদীর পানি বেড়ে দোয়ারাবাজার-বোগলাবাজার-শরীফপুর, দোয়ারাবাজার-বাংলাবাজার ব্রিটিশ সড়ক এবং দোয়ারাবাজার-ছাতক সড়কের মাজেরগাঁও, হাসপাতাল সংলগ্ন কয়েকটি পয়েন্ট পানির নিচে তলিয়েছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে লক্ষ্মীপুর, বোগলাবাজার, সুরমা, বাংলাবাজার ও নরসিংপুর ইউনিয়নের। উপজেলার বড়কাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, তাদের বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পানি উঠেছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে জেলার ছাতক পয়েন্টে পানি বেড়েছে দশমিক ৫১ সেন্টিমিটার। বর্তমানে বিপৎসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে অর্থাৎ ৯ দশমিক ৪৪ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে সুরমার পানি।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফ মুর্শেদ মিশু বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বৃষ্টিপাত কমেছে, লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেনি। বন্যার ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার উজ জামান বলেন, বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুত আছি। কন্ট্রোল রুমও চালু করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন