রাজধানীর পল্লবী এলাকায় অটোরিকশার গ্যারেজ রয়েছে চার শতাধিক; রূপনগরে দুই শতাধিক। এসব গ্যারেজে ৩০ হাজারের ওপরে অটোরিকশা রয়েছে। আর এসব অটোরিকশা কেন্দ্র করে মাসে অন্তত অর্ধকোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। এ চাঁদাবাজির নেতৃত্বে রয়েছে পল্লবী থানা যুবলীগের দুটি গ্রুপ। উচ্চ আদালত রাজধানীর সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিলেও যুবলীগ নেতাদের চাঁদা দিয়ে দেদার চলছে অবৈধ এ তিন চাকার যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর পল্লবী ও রূপনগর এলাকায় অটোরিকশার টোকেন বাণিজ্য কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে যুবলীগের দুই গ্রুপ। এরই মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন গ্রুপ দুটির নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষের এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত আহত হয়েছেন পুলিশসহ দুই গ্রুপের বেশ কয়েকজন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় একজনকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়েছে। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা নেয়নি পল্লবী থানা পুলিশ। ক্ষমতাসীন দলের এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে যে কোনো সময় বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় অটোরিকশা চালকরা।
বিবদমান যুবলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে এক গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন যুবলীগ নেতা (অবাঙালি) মুগারী আড্ডু। আড্ডু যুবলীগের সরাসরি কোনো পদপদবিতে নেই। নিজেকে পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন। আড্ডুর বড় ভাই অ্যাডভোকেট মো. সেলিম পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ভাইয়ের জোরেই আড্ডু টোকেন বাণিজ্য শুরু করেন বলে জানান স্থানীয়রা। বর্তমানে আড্ডু মহানগর যুবলীগের এক প্রভাবশালী নেতার প্রশ্রয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে। অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা।
অটোরিকশার টোকেন বাণিজ্য নিয়ে কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে কালবেলার হাতে। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৩০ জানুয়ারি রাত ৯টা ২১ মিনিটে হঠাৎ কথিত যুবলীগ নেতা মুগারী আড্ডুর নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল পল্লবীর বাউনিয়াবাদ এলাকার বিভিন্ন অটোরিকশার গ্যারেজে ঢোকে। এ সময় তারা গ্যারেজ মালিকদের অটোরিকশার জন্য টোকেন কিনতে চাপ দেন। একেকটি টোকেনের দাম ধরা হয় ২ হাজার টাকা। গ্যারেজ মালিকরা টোকেন কিনতে না চাইলে দেওয়া হয় হুমকি-ধমকি। বলা হয়, পল্লবী-রূপনগর এলাকায় অটোরিকশা চালাতে হলে তার কাছ থেকে টোকেন কিনতে হবে। তাতে সাড়া দেননি রিকশা মালিকরা।
এরপর গত ১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আড্ডুর নেতৃত্বে পল্লবীর প্রধান সড়কের প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তাণ্ডব চালায় তার বাহিনী। এ সময় আড্ডু বাহিনীর সামনে যেসব রিকশাওয়ালা পড়েছেন, তাদেরই পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করা হয়। আড্ডু বাহিনীর এ তাণ্ডব চলে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী। এ ঘটনায় ছয়জন আহত হন। ভাঙচুর করা হয় একাধিক অটোরিকশা। আড্ডু বাহিনীকে বাধা দিতে গিয়ে বেদম পিটুনির শিকার হন পল্লবী থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মোবারক হোসেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে গত ৩ জানুয়ারি পল্লবীতে অটোরিকশা চালকদের ব্যানারে কয়েকশ রিকশাচালক বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন। রিকশাচালকদের এই গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা। এরপর সোমবার ১১ নম্বরের মিল্লাত ক্যাম্পের সামনে পাল্টা মানববন্ধন হয় আড্ডুর নেতৃত্বে। এ মানববন্ধন থেকে অটোরিকশা বন্ধের দাবি জানায় আড্ডু বাহিনী।
জানতে চাইলে করিম হোসেন নামে এক রিকশা গ্যারেজের মালিক কালবেলাকে বলেন, ‘গত ৩০ জানুয়ারি রাতে আড্ডু ও তার লোকজন গ্যারেজে আসে। এ সময় আমি গ্যারেজে ছিলাম না, আমার ম্যানেজার ছিল। আড্ডু ম্যানেজারকে বলেন, এক দিনের মধ্যে টোকেন কিনতে হবে। আমরা তাতে রাজি না হওয়ায় আড্ডু বাহিনী এমন তাণ্ডব চালিয়েছে।’
শিবলু নামে আহত এক রিকশাচালক বলেন, ‘মারধরের পর আমরা থানায় মামলার জন্য গিয়েছিলাম। ওসি মামলা নেননি। বলেছেন, এখন ব্যস্ত আছি। পরে দেখছি। পরে আমরা হুমকি-ধমকির বিষয়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে একটি অভিযোগ দিই।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পল্লবী ও মিরপুর এলাকায় ২০১৩ সালের দিকে রিকশার টোকেন বাণিজ্য শুরু করেন মুগারী আড্ডু। ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি এককভাবে এ ব্যবসা পরিচালনা করেন। বিপত্তি বাধে ২০২১ সালের ১৬ মে ব্যবসায়ী শাহিন উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পরে। ওই মামলায় আড্ডুর ডান হাত সুমন বেপারীকে আসামি করা হয়। পরে সুমন গ্রেপ্তার হলে আত্মগোপনে চলে যান মুগারী আড্ডু।
আড্ডু আত্মগোপনে গেলে স্থানীয় বাউনিয়াবাদের প্রায় ১১৭টি গ্যারেজের মলিকরা মিলে ‘শ্রমিক কল্যাণ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এ সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক মো. আলম। তাদের পেছন থেকে সহায়তা করেন পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা এবং স্থানীয় ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহির উদ্দিন মানিক। তাদের বিরুদ্ধে রিকশাপ্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ চাঁদায় ভাগ বসাতে সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই আবার টোকেন বাণিজ্য শুরুর চেষ্টা চালান আড্ডু।
অভিযোগের বিষয়ে মুগারী আড্ডু কালবেলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। হাইকোর্ট কর্তৃক অটোরিকশা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আমরা এ অটোরিকশা বন্ধের দাবি জানাই। বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করায় যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। জুয়েল রানার লোকজন অটোরিকশার থেকে মাসে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা নেয়।’ এ বিষয়ে যুবলীগ নেতা জুয়েল রানার বক্তব্য নিতে তাকে একাধিকবার ফোন দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে এসএমএস পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
সার্বিক বিষয়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘রিকশাওয়ালারা গরিব মানুষ। তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উপপরিদর্শক মোবারক হোসেনের কোথাও কাটেনি। তা ছাড়া তিনি নিজেও বলতে পারছেন না, কোথায়, কীভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।’