আদর্শিক লক্ষ্য অর্জনে এখনো ১৪ দলীয় জোটকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরিকরা। এ কারণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা ইস্যুতে এক হয়ে কাজ করতে চান এসব দলের নেতারা। তাদের মূল্যায়ন, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ১৪ দলের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার সব এখনো অর্জিত হয়নি। এ কারণে রাজনৈতিকভাবে এই জোটকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি লক্ষ্য অর্জনে কর্মকৌশল নির্ধারণেরও তাগিদ দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে ১৪ দল এখনো অটুট আছে জানিয়ে শরিকদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
১৪ দলের নেতারা বলছেন, দেশের বিরুদ্ধে বিদেশি ষড়যন্ত্র এখনো চলমান। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি বিদেশি শক্তির প্রভাবে অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে ছিনিয়ে নিতে চায়। এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হলে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য ১৪ দলের মতো রাজনৈতিক শক্তির কোনো বিকল্প নেই।
তাদের মতে, জোটের নেতা শেখ হাসিনা প্রয়োজন মনে করেন বলেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতার আপত্তির মুখে এখনো জোট অটুট রয়েছে।
জানা গেছে, নির্বাচনের পর ১৪ দলীয় জোটের এখন পর্যন্ত কোনো বৈঠক হয়নি। তবে দ্রুতই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটের নেতাদের সঙ্গে বসবেন। চলতি মাসের শেষে অথবা মার্চের শুরুর দিকেই এই বৈঠক হতে পারে। সেখানে ১৪ দলের রাজনৈতিক কর্মকৌশল ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন শরিক দলের নেতারা।
১৪ দলের রাজনৈতিক লক্ষ্যের অনেক কিছুই এখনো অর্জিত হয়নি মন্তব্য করে জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু কালবেলাকে বলেন, ‘এই জোটের কিছু অর্জন ইতোমধ্যে হয়েছে। আরও কিছু বাকি আছে। এক কথায়, ১৪ দল এখনো প্রাসঙ্গিক। নির্বাচনের পর এই জোট কীভাবে কাজ করবে—তার রূপরেখা আশা করি দ্রুতই তৈরি হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জোটের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটের শরিকদের নিয়ে বৈঠকে বসে রাজনৈতিক কর্মকৌশল নির্ধারণ করবেন।’
বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোটকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক’ আদর্শের ২৩ দফার ভিত্তিতে ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটের যাত্রা শুরু হয়। যদিও এই জোটে দলের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে আটটি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। দলগুলো হলো— আওয়ামী লীগ, সাম্যবাদী দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। আর গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র ও বাসদের নিবন্ধন নেই।
২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে জোটভুক্ত হয়ে অংশ নিয়েছে ১৪ দল। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিকদের সাতটি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি একটি ও জাসদ একটিতে বিজয়ী হয়। বাকি ৫টিতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হন শরিক দলের প্রার্থীরা। এর মধ্য দিয়ে ১৪ দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বাদে বাকি শরিকদের দলীয় শক্তি সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে নানামুখী আলোচনার জন্ম হয়।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মতে, শরিক দলগুলোর সাংগঠনিক পরিস্থিতি দুর্বল হওয়ায় এবারের নির্বাচনে বেশি আসনে ছাড় দেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান বাস্তবতা মেনে নিয়ে তাদের নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী কালবেলাকে বলেন, ‘১৪ দল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে এই জোটের শরিকদের অসামান্য অবদান রয়েছে। জোটের সব নেতাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। তারা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এবং জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশের স্বার্থে লড়াই সংগ্রাম করে আসছেন। ১৪ দল আগামী দিনে রাজনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় হবে। দেশের প্রয়োজনে বরাবরের মতোই ভূমিকা রাখবে। শরিক নেতারা দেশ জাতির স্বার্থে কাজ করবেন। ১৪ দল বিলুপ্তির কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
১৪ দল ক্ষমতা ভাগাভাগির জোট নয় উল্লেখ করে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া কালবেলাকে বলেন, ‘মনগড়া কথা বা চিন্তা দিয়ে ১৪ দলকে বিলুপ্ত করা যাবে না। আদর্শিক অবস্থান, জোট বা সম্পর্ক কখনই বিলুপ্তি হতে পারে না।’
জোটের অন্যতম শরিক তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী কালবেলাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামনে অনেক সংকট আসছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষে কথা বলবেন ১৪ দলের নেতারা।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি, রাজনীতিসহ নানা দিন বিবেচনায় এখনো একটি ক্রান্তিলগ্ন চলছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রয়োজন আছে বলেই এই জোট করেছেন। তিনি না চাইলে জোট থাকবে না। তবে গত ১৫ বছরে শরিক দলগুলো দল গোছাতে না পারায় প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়েছে একথা সত্য। তার মানে, এই জোটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। আশা করি, সামনের সব রকমের দুর্যোগ প্রধানমন্ত্রী ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে অতীতের মতো মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবেন। আমি যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চান।’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চা দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে নিতে ১৪ দলের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন গণতন্ত্রী পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বিদেশি শক্তির মদদে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি দেশে নতুনভাবে সংগঠিত হচ্ছে। তারা স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে নানামুখী অপতৎপরতায় লিপ্ত। এই অপশক্তিকে মোকাবিলা করতে হলে আদর্শিক জোটের কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন প্রবীণ এই রাজনীতিক।’
জোট সক্রিয় রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশবিরোধী শক্তি বাংলাদেশকে নানাভাবে দুর্বল করে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চায়। ১৪ দলের শরিকদের শক্তি সীমিত হলেও গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে এই ঐক্য অটুট রাখতে হবে। আদর্শিক জোটের কোনো বিকল্প নেই। এখন বড় কাজ হলো এই শক্তির ঐক্য আরও বেগবান করা। দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে জোটের রাজনৈতিক কার্যক্রম আরও গতিশীল করা।’