জুনায়েদ শিশির
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪৩ এএম
আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৪, ১০:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উৎপাদনশীলতা বাড়ছে প্রাণিসম্পদ খাতে

বহুমুখী উদ্যোগ
উৎপাদনশীলতা বাড়ছে প্রাণিসম্পদ খাতে

বিপুলসংখ্যক খামারির প্রশিক্ষণ, উৎপাদিত পণ্য ব্যবস্থাপনায় গ্রুপ গঠন, পশু খাদ্য উৎপাদন ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারসহ বহুমুখী উদ্যোগের কারণে দেশে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। এ খাতের খামারিদের দক্ষ করে তুলতে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে চলমান প্রকল্পটি এরই মধ্যে প্রান্তিক খামারিদের পথ দেখাতে শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, ৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭৩ লাখ দিচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৮ বিভাগের ৬১টি জেলার সব উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। মাঝে করোনার কারণে ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। ২০২৫ সাল মেয়াদি এ খাতের সর্ববৃহৎ প্রকল্পটি এরই মধ্যে ৪৬৬টি উপজেলায় ২ লাখ ৬০ হাজার খামারিকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাড়ে ৬ হাজার উৎপাদক দল (প্রোডিউসার গ্রুপ) গঠন করা হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষ খামারি গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠিত উৎপাদক দলে ৬০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। এ ছাড়া ৪ হাজার ২০০ জনের সেবা নেটওয়ার্ক, প্রতিটি উপজেলায় প্রদর্শনী খামার, ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গবাদি পশুর টিকা কার্যক্রম, প্রজনন ও বিপাকীয় রোগ নিয়াময়, ৫০টি বিশুদ্ধ জাতের বকনা সংগ্রহ, ৪৬৬ উপজেলায় উন্নত জাতের ঘাস উৎপাদন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ৪৬ খামারে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং উপকূলীয় এলাকায় ২০টি স্থানে নিরাপদ পানির ব্যবস্থাকরণ এবং প্রকল্প এলাকায় সব খামারির ডিজিটাল ডাটাবেজ গঠন করা হয়েছে।

এলডিডিপির প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুর রহিম কালবেলাকে বলেন, ‘প্রকল্পের কার্যক্রমের ফলে প্রকল্প এলাকায় নিরাপদ দুধ ও মাংসের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে, পশুখাদ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের সেবা-সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, খামারিরা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন ও ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড গঠনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং নারী সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতি বাড়বে। ’

প্রাপ্ত তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় সুফলভোগী খামারির সংখ্যা ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২৪৯ জন। এদের মধ্যে ৬৯৮ কোটি ৯৫ লাখ ৮৫ হাজার ১২৫ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সুফলভোগীদের মধ্যে ২ থেকে ৫টি গবাদি পশু পালনকারী খামারির সংখ্যা ৩৩ হাজার ৮৪৩ জন। ৬ থেকে ৯টি পশু আছে এমন খামারি ৭০ হাজার ২৯৬ জন। ১০ থেকে ২০টি পশু আছে এমন খামারি ১৬ হাজার ৭০ জন। এ ছাড়া ব্রয়লার মুরগির ৮৫ হাজার ৪১৯ জন, লেয়ার মুরগির ৪৭ হাজার ৭৪, সোনালি মুরগির ৩৭ হাজার ৫৪৩ এবং হাঁসের ১০ হাজার ৪ খামারি এ প্রকল্পের সুফল পেয়েছে।

জানা গেছে, এ প্রকল্পের আতওায় এরই মধ্যে বাজার সংযোগ ও মূল্য শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় ১০০টি ছোট ফিড কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। ৩৮০ জন পশুখাদ্য উৎপাদন উদ্যোক্তাকে যন্ত্রপাতি স্থাপনে সহায়তা করা হয়েছে। ৪০০ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র, ২০টি ডেইরি হাব প্রতিষ্ঠা এবং ২৩২টি দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪ হাজার ৩৯১টি দুগ্ধ দোহন যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। ১৪০টি মাংসের স্লটার স্ল্যাব ও জেলা পর্যায়ে ১৮টি মানসম্মত জবাইখানা নির্মাণসহ আরও অনেক কার্যক্রম রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু সহিষ্ণু উৎপাদন পদ্ধতির উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে ২৫টি উদ্যোগ। এরই মধ্যে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৪০ জন খামারিকে সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে।

এলডিডিপির চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের যতগুলো প্রকল্প রয়েছে, তার মধ্যে এলডিডিপি বেশ ভালো পর্যায়ে রয়েছে। এটি দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসছে। গবাদি পশুর খামারে শুধু দুধ-ডিম বা মাংস নয়। এখন খামারের বর্জ্য ব্যবস্থানায় গড়ে উঠছে নতুন শিল্প। এ প্রকল্পের আওতায় পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ধরনের উত্থান ঘটবে দেশে, যা অভ্যন্তরীণভাবে অর্থনীতিতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, গবাদি পশুর খামার করে সফল হয়েছেন— এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক। খামার লাভজনক করতে হলে খামারের এলাকা, পশুর জাত, চারণভূমি, মাংস ও দুধ উৎপাদন, দুধ ও মাংসের বাজার ব্যবস্থাপনা বা সরবরাহ এবং সম্ভাব্য গ্রাহকের বিষয় মাথায় রেখে খামার গড়ে তুলতে হবে। এসব বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেকেই খামার করে লোকসানে পড়েছেন। কেউ কেউ ঋণ করে নিঃস্ব হয়ে যান। এলডিডিপির আওতায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে খামারিরা এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারের এলডিডিপি অনেক সুন্দর ও ভালো প্রকল্প। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে এ খাতের অনেক উন্নয়ন হবে। খামারিদের আরও বেশি আগ্রহী করা যাবে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে এবং দেশে দুধ ও মাংসের সমস্যার সমাধান হবে। এক কথায় প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে ডেইরি খাতের সরবরাহ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আসবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে খামারিরা সুসংগঠিত ও দক্ষ হয়ে উঠবে। এতে প্রাণিসম্পদের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, সৃজনশীল ও উন্নত পদ্ধতিতে খামার ব্যবস্থাপনার অনুশীলন হবে এবং নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে এবং নিরাপদ দুধ, ডিম, মাংস ও প্রাণিজাত খাদ্যপণ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রাণিসম্পদ দপ্তরের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এলডিডিপি প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভালো। তবে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে এই বিশাল কর্মকাণ্ডের রক্ষণাবেক্ষণ করার কেউ থাকবে না। তখন তদারকির অভাবে সব কিছু আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। সেজন্য প্রাণিসম্পদ খাতের টেকসই উন্নয়নে স্থায়ী ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার।’

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) তথ্যমতে, গ্রামে প্রতিটি পরিবার কৃষির পাশাপাশি গবাদিপশু পালন করে—যা এ দেশের মানুষের একটি অন্যতম আয়ের উৎস। খুব বেশি জায়গা প্রয়োজন না হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহজেই গবাদিপশু পালন করতে পারে।

বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ সারা বছর এবং ৫০ শতাংশ মৌসুমভিত্তিক গবাদিপশু পালন করে থাকে। জিডিপিতে এই খাতের অবদান ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আর কৃষি খাতের প্রায় ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ আসে প্রাণিসম্পদ খাত থেকে।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের পশু খামার কেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের মধ্যে ৭৬ লাখ বা ৮৮ দশমিক ২ শতাংশ নারী এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ বা ১০ লাখ পুরুষ রয়েছে। গবাদি পশুর খামারে পুরুষের অংশগ্রহণ কম থাকলেও মালিকানায় তাদের সংখ্যা এখনো অনেক বেশি। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে কৃষি খামারে গুরুত্ব রয়েছে। যেহেতু প্রান্তিক খামারের বেশিরভাগ নারীদের তত্ত্বাবধানে থাকে। তাদের শক্তিশালী করতে পারলে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাতাহাতির ঘটনায় ইসিতে এনসিপির অভিযোগ

‘কী বিক্রি করে নায়িকা হয়েছ’ শ্বেতাকে কটাক্ষ অভিনেত্রীর

চাঁদা না পেয়ে ব্যবসায়ীকে হাত-পা ভেঙে কুপিয়ে জখম

ভারতে আটক পুলিশ কর্মকর্তা আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামি

ক্রিকেট ম্যাচে ওভার না দেওয়ায় গুলি, ২ ভাই নিহত

জামায়াত আমিরের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে বাসায় গেলেন ইসহাক দার

ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদপ্রার্থীসহ দুজনের প্রার্থিতা বাতিলের সুপারিশ

লাইনচ্যুত বগি রেখেই ছেড়ে গেল ট্রেন

‘এটা কি আমার বাপের টাকায় করেছে? আমার নাম কেন থাকবে’

রুমিন ফারহানার বক্তব্যের ‘কড়া’ জবাব হাসনাতের

১০

চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে ট্রেন বিলম্বে যাত্রীদের বিক্ষোভ

১১

খালেদা জিয়া নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য : বুলু

১২

সিংহ শিকারের জন্য বেরিয়ে আসে, মোদিকে ওপেন চ্যালেঞ্জ বিজয়ের

১৩

‘বাইরে থেকে লোক এসে দেশে সড়ক বানিয়ে দেয়, এটা লজ্জার’

১৪

বাংলাদেশ পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা ভারত থেকে আটক

১৫

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর সরকারি ছুটি কবে?

১৬

শ্রাবন্তীর লেহেঙ্গায় মুগ্ধ ভক্তরা

১৭

শুক্র-শনি ছুটিসহ এনজিওতে চাকরির সুযোগ

১৮

এইচএসসি পাসেই চাকরি দিচ্ছে আকিজ গ্রুপ, পাবেন আবাসন সুবিধাও

১৯

একাদশে ভর্তির তৃতীয় পর্যায়ের আবেদন কবে?

২০
X