দীর্ঘদিন ধরেই সংকটে আছে দেশের অর্থনীতি। বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকিতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতার আভাস সবার কাছেই স্পষ্ট। এতদ সত্ত্বেও এই সমস্যাগুলোর সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণেও দেখা গেছে বিলম্ব। আবার যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেটিও কার্যকরী হচ্ছে না। এ ছাড়া সমস্যা আছে সুশাসন, দক্ষতা আর বাস্তবায়ন দুর্বলতার। এসব সমস্যার কথা সরকারের নীতিনির্ধারণী স্তর থেকে স্বীকারও করা হচ্ছে না। ফলে সমস্যাগুলো আরও পুঞ্জীভূত হচ্ছে। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরা এসব সমস্যার কথা বিভিন্ন ফেরামে বলেও আসছেন। তবে আমলে নেওয়া হয়েছে কম। এখন সেই একই কথা বলছে বিশ্বব্যাংকও।
গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, বিশ্বব্যাংক সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ওই চার সমস্যার পাশাপাশি তিন ঝুঁকির কথাও বলেছে। এগুলো হলো—দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকা; মুদ্রা বিনিময় হার সংস্কারে বিলম্বের কারণে ডলারের ঘাটতি এবং এ কেন্দ্রিক দীর্ঘস্থায়ী আমদানি নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ বহাল রাখা এবং আর্থিক খাতে সমন্বিত সংস্কার কর্মসূচিতে বিলম্ব।
অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত। সম্ভাব্য ঝুঁকিও শনাক্ত করা গেছে। তাহলে সমাধানের উপায় কী। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের বাইরে এ বিষয়েও দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদেরই বা মতামত কী, সেটি জানার চেষ্টা করেছে কালবেলা।
সংস্কার উদ্যোগেই আছে সমাধান:
এমন মতামত রেখেছেন বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক যে সমস্যা আর ঝুঁকির কথা বলেছে, সেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির বাস্তবতার নিরিখেই বলেছে। এ নিয়ে বিতর্ক করার মতো কোনো সুযোগ নেই। এগুলো দেশের অর্থনীতিবিদরাও বিভিন্নভাবে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। সমাধানে কী করা উচিত, সেটিও বলা হয়েছে। কিন্তু এর জন্য যে সংস্কার দরকার, তা বিলম্ব হওয়ার কারণেই সমস্যাগুলো এখন পুঞ্জীভূত রূপ ধারণ করেছে। আবার উদ্যোগ দরকার সেটিও ফলপ্রসূ ভূমিকায় নেই। যেমন ডলার সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগের কথা বলেছে। কিন্তু ক্রলিং পেগের অর্থ কী, সেটি কত দ্রুতততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করবে, তার রোডম্যাপ কী, কোনো কিছুই পরিষ্কার করা হয়নি। সমস্যা এখানেই।
অন্যদিকে, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে। এটা রুখতে বাজার ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করতে হবে। তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। তথ্যের মধ্যে ঘাটতি, বিভ্রাট এবং বিভ্রান্তি রয়েছে, পার্থক্য রয়েছে এগুলো নিরসণ করতে হবে। বাজেটে আমদানি এবং উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তর যে মধ্যস্বত্বভোগী, তাদের নজরদারি ও খবরদারির মধ্যে আনতে হবে। আর্থিক খাতে যে ঋণখেলাপি, এগুলোর জন্য সংস্কার দরকার। বলা হচ্ছে, উইলফুল ও নন উইলফুল এগুলোকে আলাদা করা হবে এবং উইলফুলগুলোকে আইনের আওতায় আনা হবে। মোদ্দাকথা হলো, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি দ্রুততর করতে হবে। এগুলোর জন্য বাজেটের অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। এই সংস্কারকে আশু প্রয়োজনীয় হিসেবেই দেখতে হবে।
এ ছাড়া দেশে এখন যেসব সমস্যা আর ঝুঁকির বিষয়গুলো সামনে আসছে, সেটি এক দিনের নয়। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। সমাধানও তাই এক দিনে হবে না। যেমন ব্যাংকিং খাতের সংস্কারগুলো যদি করা যায়, তাহলে এটা বিনিয়োগের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে তখন রপ্তানি থেকে শুরু করে অন্য সব কিছুতে এর ইতিবাচক ফল আসবে। বৈদেশিক মুদ্রার অবমূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় কিংবা ক্রলিং পেগ বা যাই বলি, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে এটা রেমিটেন্স এবং রপ্তানির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার এটাও ঠিক, এখন যে ঝুঁকি, এর পূর্ববর্তী যে অবস্থান ছিল–অর্থাৎ নিম্ন মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং মোটামুটিভাবে একটা সহনীয় বিনিয়োগ, ওখানে এক দিনে ফিরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু এটা সম্ভব, যদি আমরা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমাই। এর জন্য ক্রলিং পেগ উদ্যোগ দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে।
আবার বাড়তি রাজস্ব বাড়ানোর চাপ অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি তৈরি করছে। কারণ, আমরা রাজস্ব আদায়ে সহজ উদ্যোগ হিসেবে সব সময় পরোক্ষ করে জোর দিচ্ছি। এতে করে সমাজে বৈষম্য প্রবল হচ্ছে এবং অনেকের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে বাজেটীয় উদ্যোগে প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি জোর দেওয়া। এতে যার সম্পদ বেশি, তার ওপর বা ধনীদের ওপর বেশি করারোপ হবে। এ ধরনের করারোপ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেবে। এখন কাজ হলো এসব চ্যালেঞ্জ কত সুচারুভাবে মোকাবিলা করা যায়, তার উদ্যোগ নেওয়া।
মুদ্রা বিনিময়হারের বাজারভিত্তিক ব্যবস্থাপনা জরুরি:
অর্থনৈতিক দ্রুত স্থিতিশীলতার জন্য মুদ্রা বিনিময়হারের ব্যবস্থাপনা থেকে বাজারভিত্তিক ব্যবস্থাপনার দিকে যাওয়ার বিষয়ে সরকারকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক শাখার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার চাপ, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট এবং আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা—এই তিনটি বিষয়ের ওপর এখন সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, আমরা যে সংকটে আছি, এগুলোকে যদি কাটানো না যায়, তাহলে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি যে রূপায়ন কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন বাড়ানো যাবে না। এজন্য সংস্কার উদ্যোগে মুদ্রা বিনিময়হারের ব্যবস্থাপনা থেকে বাজারভিত্তিক ব্যবস্থাপনার দিকে যাওয়ার বিষয়ে সরকারকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
ড. জাহিদ বলেন, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফাঁদে রয়েছে দেশ। এটা নামিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ রয়েছে, সেগুলো যথেষ্ট হবে না। আবার এগুলো থেকে পেছানোও যাবে না। বিশেষ করে সুদের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনেক ধরনের চাপ আসবে। কিন্তু আমরা যদি মূল্যস্ফীতিকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে সুদের হার কমানোর কোনো বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। আবার এই উদ্যোগ যে কোনোরকম কষ্টের সৃষ্টি করছে না, তাও নয়। কিন্তু সেগুলো মোকাবিলা করতে হবে অন্যভাবে, সুদের হারে ছাড় দিয়ে নয়। কারণ, এটা ছাড় দিলে মূল্যস্ফীতি আরও লাগামহীন হয়ে পড়বে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
তিনি বলেন, আর্থিক খাত সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে এ প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে বলব, জোর করে চাপিয়ে দিলে রোগের চেয়ে চিকিৎসাটাই বড় সমস্যা হয়ে যেতে পারে। এজন্য আগে একটা হোমওয়ার্ক জরুরি। দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স সিটটা কী রকম—এ বিষয়ে একটা নিরপেক্ষ অডিট হওয়া দরকার। যার ভিত্তিতে সবাই বুঝতে পারবে, এখানে যে সম্পদ আছে, সেখানে কতটা ভালো এবং কতটা মন্দ সম্পদ। তাদের দেনা কত, কর্মী কত, ব্রাঞ্চ কত এবং তাদের ব্যবস্থাপনাগুলো কী রকম অর্থাৎ ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটা হোলস্টিক ধারণা। পুরোপুরি তথ্য না জেনে তো কেউ এগুলোকে নেবেন কি নেবেন না, এই সিদ্ধান্তে যাওয়া যাবে না। এ ছাড়া কোন কোন মানদণ্ডে ব্যাংক একীভূত হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা নীতি প্রণয়ন করা দরকার। এখানে মূলত তিনটি বিষয় ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করার কথা। যেমন মার্জার, একিভিশন এবং অবসায়ন। এ পথগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। এরপর দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা কীভাবে নিষ্পত্তি করা হবে, সেগুলো নির্ধারণ করা।
অন্যদিকে বাজেট আসছে। এর বড় চ্যালেঞ্জ হলো ঋণ এবং সুদ ব্যয় বাড়ার কারণে ঘাটতি আরও বড় হয়ে যাচ্ছে। এই বাজেটে একদিকে মূল্যস্ফীতির কথা মাথায় রেখে বাজেট ঘাটতিকে আর না বাড়তে দেওয়া এবং সহনীয় পর্যায়ে রাখা, এই চেয়ে বেশি ঘাটতি হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং ঘাটতি অর্থায়নের জন্য টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিতে হবে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।
একইভাবে ওই ধরনের পরিস্থিতি যাতে সামনে না আসে, তার জন্য রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কোন ব্যয়গুলো না করলেও চলে, সেটি গুরুত্ব দিতে হবে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোর সঙ্গে কোনো আপস করা যাবে না। কারণ, এখনো দেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট কাটেনি। ডলারের ক্ষেত্রে দাম কিছুটা কমলেও অস্বস্তি রয়েই গেছে। কারণ, আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ তো এখনো ওঠানো যাচ্ছে না। আবার এই নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকলে প্রবৃদ্ধির ওপর বড় আঘাত আসবে। এতে কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হবে। কাজেই বাজেটে ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ করে উন্নয়ন বাজেটে দেশীয় অর্থায়নে ব্যয়ের ক্ষেত্রে যেমন স্থানীয় সরকার, পরিবহন, জ্বালানিসহ এমন কিছু খাতে কড়াকড়ি আরও বাড়াতে হবে। অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কর্মসূচিতে নজর বাড়াতে হবে। সবার বাজেট গড়ে ৫ শতাংশ করে কমিয়ে দিলে তো সাশ্রয় উদ্যোগ হলো না। তাহলে বাজেটের লক্ষ্য অর্জনই ব্যাহত হবে। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ট্যাক্স রেট খুব একটা বাড়ানোর সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে আওতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে লিকেজগুলো কমাতে হবে। যাতে সঠিক পরিমাণের রাজস্ব সঠিকভাবে সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই করদাতারা কর দিচ্ছে, কিন্তু সরকার পাচ্ছে না। এজন্য কর প্রশাসনের দুর্নীতি কমিয়ে দক্ষতা বাড়ানোয় গুরুত্ব থাকতে হবে। এখন এগুলোই হচ্ছে পরামর্শ। এখন কতটা করবে, কতটা নেবে। কতটা বাস্তবায়ন হবে, তার ওপরই নির্ভর করছে আশু সংকট উত্তরণের।