তারা সতীর্থ। বলীর কসরত শিখেছেন একই ওস্তাদের কাছে। দারুণ সেসব কসরত দেখিয়ে এবার মাতিয়ে তুলেছেন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার ১১৫তম আসর। তাদের একজন এবারের নতুন চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার বাঘা শরীফ, অন্যজন রানারআপ মো. রাশেদ। দুজনই কুস্তির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন গতবারের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলীর কাছে। এদিকে এবারও তৃতীয় হয়েছেন খাগড়াছড়ির সৃজন চাকমা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের অস্থায়ী মঞ্চে শুরু হয় বলীদের লড়াই। সকাল থেকে রেজিস্ট্রেশন করে যাচাই-বাছাই শেষে মূল মঞ্চে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ৮০ কুস্তিগির। প্রধান অতিথি হিসেবে ঐহিত্যবাহী এ মেলার উদ্বোধন করেন রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।
প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে ময়দান। আশপাশের বিভিন্ন ছাদ এবং ভবনের উঁচু স্থানে অনেকে ভিড় জমান। কুস্তিগিররাও বিভিন্ন ভঙ্গিতে শারীরিক কসরত দেখিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিতে শুরু করেন। ৮০ কুস্তিগিরের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত শুরু হয় বহুল প্রতীক্ষিত এ
প্রতিযোগিতা। কখনো মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, কিংবা কপাল-কাঁধ ঠেকিয়ে লড়তে শুরু করেন কুস্তিগিররা। শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে মুখোমুখি হন রাশেদ ও সৃজন চাকমা এবং বাঘা শরীফ ও মো. রাসেল। সেমিফাইনালে দুই ম্যাচ চলে প্রায় ৩০ মিনিট। সেমিফাইনালে বিজয়ী হয়ে ফাইনালে ওঠেন মো. রাশেদ ও বাঘা শরীফ। অন্যদিকে, রাসেলকে হারিয়ে এবারও তৃতীয় হন সৃজন চাকমা। এ নিয়ে পরপর তিনবারই তিনি তৃতীয় হয়েছেন।
ফাইনালে ১১ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস লড়াই:
বিশালাকার শরীর আর চাহনিতে লড়াকু ভাব। দুজনই একই গুরুর শীর্ষ হওয়ায় একে অন্যজনকে চেনেন খুব ভালোভাবেই। আবার দুজনের বাড়িও একই জায়গায়। তবে লড়াই শুরুর পর কেউ যেন কাউকে ছাড় দেন না। ফাইনালে বাঘা শরীফ ও মো. রাশেদ দুজনই মরিয়া হয়ে ওঠেন জেতার জন্য। চলতে থাকে একের পর এক ঘাত-প্রতিঘাত। এভাবে প্রায় ১১ মিনিট জমজমাট লড়াই চলে তাদের মধ্যে। শুরু থেকে জিততে মরিয়া হলেও শেষ দিকে এসে হাল ছেড়ে দেন রাশেদ। হঠাৎ সতীর্থ শরীফের হাত তুলে ধরে জানান দেন হার মানার।
এ সময় চ্যাম্পিয়ন শরীফ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, গতবারের চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল বলী খেলায় অংশ না নিয়ে আমাকে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে, রানারআপ রাশেদ বলেন, আমি আগে বলী খেলায় অংশ নিইনি। আমাকে খেলায় নিয়ে এসেছেন শরীফ ভাই। তাই তাকে জয়ী করে দিয়েছি।
অন্যদিকে, দুই শিষ্যকে সুযোগ করে দিতে এবার খেলায় অংশ নেননি কুমিল্লার শাহজালাল বলী। এভাবে বলী খেলায় কুমিল্লার ওস্তাদ-সতীর্থদের এমন ভালোবাসাকে অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি চট্টগ্রামের দর্শকরা।
পতেঙ্গা থেকে আসা তরুণ মো. ইমতিয়াজ কালবেলাকে বলেন, ‘বলী প্রতিযোগিতায় ওস্তাদ-সতীর্থদের এমন ভালোবাসা দেখে খুবই ভালো লেগেছে।’
লড়ছেন ৭১ বছরেও:
জীর্ণশীর্ণ শরীর, গালভর্তি সাদা দাড়ি। ৭২-এর ঘরে বয়স, অথচ এখনো বলীর নেশা কাটিয়ে উঠতে পারেননি খাজা আহমদ। বাবার হাত ধরে ১১ কি ১২ বছর বয়স থেকে বলী খেলায় অংশ নিচ্ছেন তিনি। ফুসফুসে নানা সমস্যা। গত বছর বলেছিলেন অসুস্থতার কারণে আর অংশ নেবেন না বলী খেলায়। কিন্তু এ নেশা কাটেনি তার। গতকালও তাকে দেখা গেছে লালদীঘির মাঠে। উঠেছেন স্টেজে, লড়েছেন বুক ফুলিয়ে।
খাজা আহমদ জানালেন, তার বাবাও বলী খেলা খেলতেন। ১১ কি ১২ বছর বয়স থেকে তিনি নিজেও বলী খেলায় অংশ নিচ্ছেন। জব্বারের বলী খেলায় ৫১ বছরের বেশি সময় ধরে অংশ নিচ্ছেন। একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বলেও দাবি তার।
কৃষিকাজ করেন খাজা আহমদ। তার বাড়ি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়। এলাকায় তিনি ‘খাজা আহমদ বলী’ নামে পরিচিত।