দেশে দুই বছর ধরেই ডলারের বাজারে চলছে অস্থিরতা। মার্কিন এ মুদ্রার সংকটের সুযোগ নিয়ে নানা কারসাজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ধরা পড়ে শাস্তির মুখেও পড়েছে কেউ কেউ। তবে ডলার নিয়ে অভিনব কায়দায় কারসাজি করেও পার পেয়ে গেছে পূবালী ব্যাংক পিএলসি। খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যাংকটিকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) নির্ধারিত দরের বেশিতে ডলার বিক্রি করে ২৪৮ কোটি টাকা আয় করে বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংক। একই সময়ে বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে বেশি দরে ডলার ক্রয় করে অতিরিক্ত ২১১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ব্যাংকটি। শুধু তাই নয়, আয় ও ব্যয় করা অতিরিক্ত অর্থ লেনদেনের জন্য কয়েকটি সাসপেন্স অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। প্রয়োজনীয় লেনদেন শেষে এই হিসাবগুলো মুছে ফেলার (ডিলিট) পরিকল্পনা ছিল ব্যাংকটির। তবে তার আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
পরিদর্শন দল এ অনিয়ম চিহ্নিত করে। এরপর ডলার কেনাবেচা ও সংশ্লিষ্ট হিসাবগুলোর বিস্তারিত তথ্য চেয়ে পরিদর্শক দলের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়। সেই সময় ব্যাংকটিকে এ বিপত্তি থেকে বাঁচতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার শরণাপন্ন হয় পূবালী ব্যাংক। তার হস্তক্ষেপে তদন্ত প্রক্রিয়া সেখানেই থামিয়ে দিতে বাধ্য হন পরিদর্শকরা। মাত্র একটি শাখার এ অনিয়মের সূত্র ধরে পূবালী ব্যাংকের অন্যান্য এডি শাখা পরিদর্শনের উদ্যোগও আর অগ্রসর হতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিমের বিশেষ পরিদর্শনে দেখা যায়, পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সেন্ট্রালাইজড ট্রেড প্রসেসিং ইউনিট (কেন্দ্রীভূত বাণিজ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট) বৈদেশিক মুদ্রার ধরন নির্দিষ্ট করে দিলেও আমদানি বিল ইস্যুর জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে
অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকটি আমদানিকারকদের কাছ থেকে নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত ১৪৮ কোটি টাকা আদায় করে। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ ব্যাংকের মতিঝিল ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখার বেশ কয়েকটি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এজন্য কোনো রকম অনুমোদন না নিয়েই ফরেন এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর নামে সাতটি হিসাব খোলা হয়।
একই সময়ে ব্যাংকটি বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউসের কাছ থেকে নির্ধারিত দরের চেয়ে উচ্চমূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা কিনেছে। একটিমাত্র এডি শাখার মাধ্যমেই বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে অতিরিক্ত ২১১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক্সচেঞ্জ হাউসের নামে খোলা পূবালী ব্যাংকের সাতটি হিসাবের মধ্যে চারটির অনুমোদন দিয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব)। অন্য তিনটি হিসাব কার অনুমতি নিয়ে খোলা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, পূবালী ব্যাংক ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি দরে এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কেনার ক্ষেত্রে উচ্চমূল্য পরিশোধ করে। এর মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বিপরীতে অতিরিক্ত প্রণোদনা দেওয়ায় সরকারের ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা অপচয় হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পূবালী ব্যাংকের এসব অনিয়ম চিহ্নিত করার পর অন্যান্য শাখায় পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। তবে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেই উদ্যোগ আটকে দেন। এমনকি উদ্ঘাটিত অনিয়মের জন্য পূবালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী কালবেলাকে বলেন, ‘২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে এ ধরনের একটি অভিযোগ করা হয়েছে; কিন্তু পূবালী ব্যাংক কখনো আইনের বাইরে কাজ করে না। আমরা বাজারদর অনুযায়ী ডলার কিনেছি এবং বিক্রি করেছি। পূবালী ব্যাংক সবসময়ই কমপ্লায়েন্স।’
নির্ধারিত দরের বেশি দরে ডলার কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো দর বেঁধে দেয়নি। এ সম্পর্কে আপনাদের ভুল ধারণা আছে।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন বলছে, সে সময় মার্কিন ডলারের বাফেদা ঘোষিত দর ছিল ১০৯ টাকা থেকে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু ব্যাংকটি ওই সময় ১১৩ টাকা থেকে ১২৩ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত দরে ডলার কিনেছিল।
লেনদেন হয়েছে যেসব এক্সচেঞ্জ হাউসের নামে:
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ওই সময় অ্যারাবিয়ান এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ১ কোটি ৫২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আনে পূবালী ব্যাংক। এ সময় বাজারের দর ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১০ টাকার মধ্যে হলেও ব্যাংকটি ডলার কিনেছে সর্বোচ্চ ১১৭ টাকায়। এতে ব্যাংকটিকে অতিরিক্ত ৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।
মার্চেনট্রেডের কাছ থেকে ৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার কিনতে সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা দর দিয়েছে ব্যাংকটি। এতে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৪০ কোটি টাকা।
গালফ ওভারসিজ এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে ৪ কোটি ৮৭ লাখ ডলার কেনা হয় সর্বোচ্চ ১২২ টাকা দরে। এজন্য অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয় ২৬ কোটি টাকা।
ইউনিভার্সাল এক্সচেঞ্জ সেন্টার থেকে সর্বোচ্চ ১২২ টাকা ৫০ পয়সা দরে ৭৭ লাখ ডলার কিনে পূবালী ব্যাংক, এতে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
এনবিএল মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে ৪৫ লাখ ডলার কিনেছে ব্যাংকটি। এতে সর্বোচ্চ দর ছিল ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা, যার কারণে ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে।
ব্যাংকটি কন্টিনেন্টাল এক্সচেঞ্জ সলিউশন্সের (আরআইএ) মাধ্যমে ১০ লাখ ৬০ হাজার ডলার কিনেছে। এতে সর্বোচ্চ দর ছিল ১২৩ টাকা ৬০ পয়সা। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ১১০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া মাল্টিনেট ট্রাস্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ৫ কোটি ৮৬ লাখ দিরহাম রেমিট্যান্স কিনেছে পূবালী ব্যাংক। এতে নির্ধারিত রেট ছিল ৩০ টাকা ০৮ পয়সা। কিন্তু ব্যাংকটি রেমিট্যান্স কিনেছে সর্বোচ্চ ৩৩ টাকা ২১ পয়সা দামে। এতে বাড়তি খরচ হয়েছে ১৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে আরও বলা হয়েছে, পূবালী ব্যাংক বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে আমদানিকারকদের কাছ থেকে থেকে বিল মূল্য বাবদ ঘোষিত দরের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছে। এই অর্থ মতিঝিল ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখার ৭টি হিসাবের বাইরেও ব্যাংকের অন্যান্য শাখার বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। এমনকি এ কাজে বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাবও ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে পূবালী ব্যাংকের বরিশাল হসপিটাল রোড শাখা একটি এলসির বিপরীতে ৫৬ হাজার ৮৫০ টাকা আদায় করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন কালবেলাকে বলেন, ‘ডলার সংকটের সুযোগে কেউ যদি কারসাজি করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তার নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনারও ব্যত্যয়। সুতরাং যারা এ ধরনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা উচিত। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংককে শাস্তির আওতায় এনেও তাদের ক্ষমা করে দিয়েছে। এটা ঠিক হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সব ব্যাংককে সমানভাবে মূল্যায়ন করা। কেউ যদি অন্যায় করেও পার পেয়ে যায়, তাহলে তা ব্যাংকগুলোকে ভুল বার্তা দেবে। অন্য ব্যাংকও অন্যায়ে উদ্বুদ্ধ হবে। তাই নীতি সবার জন্য একই হওয়া উচিত।’
সার্বিক বিষয় জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, ‘কোনো ব্যাংক যদি অনিয়ম করে, তা ধরার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন শাখা রয়েছে। ওই শাখা যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পায় তাহলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’