দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন করে সরকারবিরোধী আন্দোলন গতিশীল করতে জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের চিন্তা ছিল বিএনপির। সেখান থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। নানা কারণে সহসাই কাউন্সিল হচ্ছে না। তবে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেজন্য কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ে বড় ধরনের রদবদল হতে যাচ্ছে। গঠনতন্ত্রে দেওয়া ক্ষমতাবলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলের হাইকমান্ড এরই মধ্যে নির্বাহী কমিটির শূন্য পদগুলো চিহ্নিত করেছে। নির্বাচনের পর কিছু কিছু পদ পূরণ করা হলেও এবার বাকি শূন্য পদগুলো শিগগির পূরণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পর্যন্ত বিভিন্ন পদে নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতার ভাগ্য খুলতে পারে। আবার বিগত আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় থাকা নেতাদের কেউ কেউ পদ হারাতে পারেন। কারও কারও পদাবনতিও ঘটতে পারে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে খালেদা জিয়া দলটির চেয়ারপারসন এবং তারেক রহমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। এরপর ৩০ মার্চ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব এবং রুহুল কবির রিজভীকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ঘোষণা করা হয়। ওই বছরের ৬ আগস্ট জাতীয় স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদ মিলিয়ে ৫৯২ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে উপদেষ্টা ও নির্বাহী কমিটিতে আরও কিছু নেতাকে পদায়ন করা হয়।
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর সম্মেলন (কাউন্সিল) করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করার কথা। সেই হিসেবে বর্তমান কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ পাঁচ বছর আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিলের পর দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় সরকার পতনের লক্ষ্যে ধারাবাহিক আন্দোলনও করেছে বিএনপি। মূলত সরকারবিরোধী আন্দোলনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এবং এর জেরে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী মামলা, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হওয়ায় কাউন্সিল করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা।
জানা গেছে, সর্বশেষ গত মার্চের প্রথম দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠকে দলীয় কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা হলেও পরবর্তী সময়ে সেটি আর অগ্রসর হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা এখন আন্দোলনের মধ্যে আছি। তার পরও কাউন্সিল করার চেষ্টা ও ইচ্ছা আমাদের আছে। সেটাও আমরা সময়মতো করব।’
তিনি বলেন, ‘সাংগঠনিক পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কিছু শূন্য পদ পূরণ করা হয়েছে। বাকিগুলোও যথাসময়ে পূরণ করা হবে।’
বিএনপির আন্দোলন ও বর্জনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে নতুন নির্বাচন দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সেই আন্দোলন সামনে রেখে বিএনপি এখন কাউন্সিলের চেয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
জানা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখন অর্ধশতাধিক পদ শূন্য রয়েছে। নেতাদের মৃত্যু, দলত্যাগ, অব্যাহতি, পদোন্নতি ও পদাবনতিজনিত কারণে এসব পদ শূন্য হয়েছে। এ ছাড়া বয়সের কারণে অনেকে দলীয় ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সক্রিয় থাকা নেতাদের দিয়েই শূন্য পদগুলো পূরণ করা হবে। আন্দোলন-পরবর্তী বিভিন্ন সাংগঠনিক ও মূল্যায়ন প্রতিবেদনে সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় খালেদা জিয়া বর্তমানে রাজনীতির বাইরে রয়েছেন। এ কারণে দল পরিচালনাসহ কোনো বিষয়ে সাধারণত তিনি সিদ্ধান্ত দেন না। মূলত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একক নেতৃত্বেই চলছে বিএনপি। দলীয় গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে পদ রয়েছে ১৯টি। কাউন্সিলের পর ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ শুরু থেকেই দুটি পদ শূন্য ছিল। পরবর্তী সময়ে এম কে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা গেলে ছয়টি পদ শূন্য হয়। সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করায় সেটি সাতে দাঁড়ায়। পরে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটিতে যুক্ত করা হয়। বর্তমানে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী এই ফোরামে পাঁচটি পদ খালি আছে।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বর্তমান সদস্যদের মধ্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া অসুস্থ। তবে তারা স্বপদেই বহাল থাকতে পারেন। দলের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আযম খান, জয়নাল আবেদিন ও নিতাই রায় চৌধুরীর মধ্য থেকে স্থায়ী কমিটির শূন্য পদ পূরণ করা হতে পারে বলে বিএনপিতে আলোচনা আছে। এ ছাড়া দলের ‘মুখপাত্র’ করে রুহুল কবির রিজভীকেও স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে পদোন্নতি দিয়ে স্থায়ী কমিটি কিংবা ভাইস চেয়ারম্যান করা হতে পারে। ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে খায়রুল কবির খোকনকেও।
জানা যায়, বিএনপির ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে বহিষ্কার, পদত্যাগ, অব্যাহতি ও মৃত্যুজনিত কারণে বর্তমানে ১৩টি পদ শূন্য রয়েছে। এই পদের জন্য আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জয়নুল আবদিন ফারুক, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, ইসমাইল জবিউল্লাহ, অধ্যাপিকা শাহিদা রফিক, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, তাহসিনা রুশদির লুনা, আব্দুস সালাম ও অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারের নাম আলোচনায় রয়েছে।
বিএনপিতে চেয়ারপারসন ও মহাসচিবের পরে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারেক রহমান দলটির প্রথম সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হন। এরপর পর্যায়ক্রমে মির্জা ফখরুল ও রুহুল কবির রিজভী এই পদে আসীন হন। জানা গেছে, দলের গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পাদকীয় পদে থাকা একজন সাবেক ছাত্রনেতাকে পদোন্নতি দিয়ে আগামীতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হতে পারে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে তারেক রহমানের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে নেতাকর্মীদের কাছে পরিচিত।
জানা গেছে, সাংগঠনিক কার্যক্রম গতিশীল করতে সাংগঠনিক সম্পাদকদের পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে যুগ্ম মহাসচিবদেরও সম্পৃক্ত করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিভাগভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে একজন করে যুগ্ম মহাসচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সেজন্য আগামীতে যুগ্ম মহাসচিবের সংখ্যা সাত থেকে বাড়িয়ে ১০ জন করা হতে পারে।
একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বেশ কয়েকটি নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, চট্টগ্রামে বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও ওবায়দুর রহমান চন্দন, খুলনায় আজিজুল বারী হেলাল ও অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, বরিশালে এবিএম মোশাররফ হোসেন, সিলেটে জি কে গউছ, কলিম উদ্দিন মিলন ও আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, ফরিদপুরে শহিদুল ইসলাম বাবুল ও সেলিমুজ্জামান সেলিম, রংপুরে আবদুল খালেক এবং ময়মনসিংহে শরিফুল আলমের নাম আলোচনায় রয়েছে। আবার অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে যুগ্ম মহাসচিবও করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদকদের অনেককে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম মহাসচিব করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আসাদুল হাবিব দুলু, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আব্দুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিলকিস জাহান শিরিন ও শামা ওবায়েদের নাম আলোচনায় আছে। অবশ্য দুই দুলুকে ভাইস চেয়ারম্যানও করা হতে পারে। এ ছাড়া শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী ও অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকেও যুগ্ম মহাসচিব করা হতে পারে। খুলনা বিভাগীয় সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে যুগ্ম মহাসচিব করা হতে পারে বলে জোর গুঞ্জন আছে। তিনি অনেক আগেই দলে ফেরার জন্য আবেদন করেছেন।
দলীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সম্পাদক পদে এ্যানি, প্রিন্স ও জহির উদ্দিন স্বপনের নাম দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে। তবে স্বপনকে যুগ্ম মহাসচিবও করা হতে পারে। অন্যদিকে বর্তমানে দলের দপ্তরে সংযুক্ত নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারী ও তারিকুল ইসলাম তেনজিংকে পদোন্নতি দিয়ে সহ-দপ্তর সম্পাদক করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ও মুনির হোসেনকে পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে। পদোন্নতি পেতে পারেন সহ-অর্থনৈতিকবিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমনও।
বিএনপির অনেক নেতার ধারণা, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে আগামীতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের সমস্যা তৈরির চেষ্টা করা হতে পারে। সেই বিবেচনায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে আনার কথা ভাবা হচ্ছে। এতে দলে তারেক রহমানের কর্তৃত্ব আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
বিগত আন্দোলন সফল না হওয়ার প্রেক্ষাপটে মির্জা ফখরুল ইসলামের মহাসচিব পদে থাকা না থাকা নিয়ে বিএনপিতে নানা আলোচনা শুরু হয়। শারীরিক অসুস্থতা ও পারিবারিক কারণে তিনি নিজেও দলীয় পদে ‘থাকতে চান না’ বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। গত ফেব্রুয়ারিতে কারামুক্তির পর দলীয় চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে মির্জা ফখরুল নিজেই বিষয়টি তুলে ধরেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানান। তবে দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের মতে, সারা দেশের নেতাকর্মী ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় এই মুহূর্তে বিএনপি মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুলই অপরিহার্য। তা ছাড়া দলীয় চেয়ারপারসনও মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুলের ওপর আস্থা রাখছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনদের দাবি। সব মিলিয়ে কাউন্সিলের আগে বিএনপিতে মহাসচিব পদে কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।