দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষায় পাস নম্বর ৪০। আর ৮০ নম্বরের বেশি পেলে এক শিক্ষার্থী এ প্লাস বা সিজিপিএ ৪ পায়। কিন্তু নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এনএসইউ) পাস নম্বর ৬০। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থী ৫৯ পেলেও তাকে অকৃতকার্য ধরা হয়। সিজিপিএ ৪ পেতে হলে এনএসইউর শিক্ষার্থীকে সর্বনিম্ন ৯৩ নম্বর পেতে হয় পরীক্ষায়। আবার একই নম্বরে সর্বোচ্চ সিজিপিএ নির্ধারণ করা হয় ইউল্যাবে। এদিকে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস নম্বর ৫০। সেখানে ৯০ নম্বর পেলেই শিক্ষার্থী সিজিপিএ ৪ অর্জন করে। তবে সেক্ষেত্রে তার গ্রেড ধরা হয় ‘এ’। ‘এ প্লাস’ পেতে হলে তাকে ৯৭ বা তার বেশি পেতে হয়।
স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি ও বেসরকারি তথা দেশের সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমন্বিত গ্রেডিং পদ্ধতি প্রণয়ন করে অনুসরণের নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সরকারি সব এবং বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতি অনুসরণ করলেও প্রথম সারির ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতি মানছে না। এ সমস্যার সমাধানে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষদের নিয়ে সভা করার কথা বলছে ইউজিসি।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি মানছে না নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ); ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি); আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি); ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি; ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব) এবং ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ)।এর আগে ২০২২ সালে শীর্ষস্থানীয় সাত বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি পাঠিয়ে অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণের জন্য সময় বেঁধে দেয় ইউজিসি। কিন্তু তাতে খুব বেশি কাজ হয়নি। চিঠি পেয়ে গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণ শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।
ইউজিসি প্রণীত গ্রেডিং পদ্ধতিতে দেখা যায়, ৮০ বা তার বেশি নম্বর পেলে শিক্ষার্থীকে ‘এ প্লাস’ বা সিজিপিএ ৪ দেওয়া হবে। ৭৫ থেকে ৭৯ নম্বর পেলে ‘এ রেগুলার’ বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৭৫ এবং ৭০ থেকে ৭৪ পেলে ‘এ মাইনাস’ বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ পাবে। ৬৫ থেকে ৬৯-এর জন্য ‘বি প্লাস’ বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ২৫, ৬০ থেকে ৬৪-এর কম পেলে তা ‘বি রেগুলার’ বা সিজিপিএ ৩ হিসেবে শনাক্ত করা হবে। একইভাবে ৫৫ থেকে ৫৯ এর জন্য ‘বি মাইনাস’ বা সিজিপিএ ২ দশমিক ৭৫; ৫০ থেকে ৫৪-এর জন্য এ ‘সি প্লাস’ বা সিজিপিএ ২ দশমিক ৫ দেওয়া হবে। ব্যক্তি পরীক্ষায় ৪৫ থেকে ৪৯ পেলে তা ‘সি রেগুলার’ বা সিজিপিএ ২ দশমিক ২৫; ৪০ থেকে ৪৪ পেলে ‘ডি’ বা সিজিপিএ ২ অধিকারী হবেন তিনি। ৪০-এর কম হলে ‘এফ’ বা অকৃতকার্য দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে ইউজিসির।
কিন্তু দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের তৈরি পদ্ধতি অনুযায়ী ইচ্ছামতো গ্রেডিং ও লেটার গ্রেড প্রদান করছে। ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ৮০ নম্বর পেলে শিক্ষার্থীরা ‘এ প্লাস’ বা সিজিপিএ ৪ পায়, সেখানে একই নম্বর পেয়ে এনএসইউতে বি-মাইনাস পান শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এনএসইউতে ৯৩ বা তার বেশি নম্বর পেলে এ এক্সিলেন্ট বা সিজিপিএ ৪ দেওয়া হয়। ৯০-৯২ পেলে এ মাইনাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৭০, ৮৭-৮৯ পেলে বি প্লাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩০, ৮৩-৮৬ পেলে বি গুড বা সিজিপিএ ৩ এবং ৮০-৮২ পেলে বি মাইনাস বা সিজিপিএ ২ দশমিক ৭০ দেওয়া হয়। আইইউবিতে ৯০-এর বেশি পেলে তাকে এ গ্রেড বা সিজিপিএ ৪ দেওয়া হয়। তাদের গ্রেডিংয়ে এ প্লাস নেই। ৮৫-৯০ শতাংশ নম্বর পেলে এ মাইনাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৭০, ৮০-৮৫ শতাংশ নম্বর পেলে বি প্লাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩০ দেওয়া হয়। আর ৪৫ শতাংশ নম্বর পেলে পাস ধরা হয়।
ইউআইইউতে ৯০ বা তার বেশি পেলে শিক্ষার্থীরা এ (প্লেইন) বা সিজিপিএ ৪ পায়। ৮৬ থেকে ৮৯ নম্বর পেলে এ মাইনাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৬৭, ৮২-৮৫ নম্বর পেলে বি প্লাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩৩ এবং ৭৮-৮১ পেলে বি (প্লেইন) বা সিজিপিএ ৩ দেওয়া হয়। পাস করতে পেতে হয় ন্যূনতম ৫৫।
এআইইউবি ৯০ নম্বরে সিজিপিএ ৪ দেওয়ার পাশাপাশি লেটার গ্রেডে এ প্লাস দিচ্ছে। ৮৫-৯০ নম্বর পেলে এ বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৭৫ এবং ৮০-৮৫ পেলে বি প্লাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫০ দেওয়া হয়। আর পাস নম্বর ৫০। আবার ইউল্যাবে এ প্লাস পেতে হলে ৯৩ নম্বর পেতে হয়। আর পাস মার্ক ৪০। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে সিজিপিএ ৪ দুইভাবে দেওয়া হয়। ৯০-৯৭ নম্বর পেলে এ এক্সিলেন্ট এবং ৯৭-১০০ পেলে এ প্লাস এক্সেপশনাল। এ ছাড়া ৮৫-৯০ নম্বর পেলে এ মাইনাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৭০ এবং ৮০-৮৫ নম্বর পেলে বি প্লাস বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩০ দেওয়া হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস নম্বর ৫০।
জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সৈয়দ মাহফুজুল আজিজ কালবেলাকে বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন গ্রেডিং হলে ভালো। উন্নত অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অভিন্ন গ্রেডিংয়ে চলে। এতে শিক্ষার্থীদেরও সুবিধা। তবে এখানে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।
এ বিষয়ে এনএসইউ, আইইউবি, ইউআইইউ, এআইইউবি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে ইউল্যাবের জয়েন্ট রেজিস্টার মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, অনেক আগে ইউজিসি থেকে অভিন্ন গ্রেডিং চালুর চিঠি পেয়েছি। এরপর বিষয়টি নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি।
ইউজিসি বলছে, পরীক্ষায় মূল্যায়নে ভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণ করায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে চাকরির বাজার কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার ক্ষেত্রে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের অন্ত নেই।
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির গ্রেডিং অনুসরণ করলেও কয়েকটি তা মানছে না। এ বিষয়ে তাদেরও কিছু বক্তব্য রয়েছে। নিজস্ব পদ্ধতিতে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু রাখতে চায় তারা।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ কালবেলাকে বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন একই গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেজন্যই অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়। কিন্তু কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো তাদের মতো করে গ্রেডিং দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে বসব। কারণ তাদের কথাও শুনতে হবে। বিশেষজ্ঞদেরও রাখা হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর দাবি জানান শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও বর্তমান অধ্যাপক ড. মো. সেকেন্দার আলী। তিনি কালবেলাকে বলেন, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি না মানায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক শিক্ষার্থী ভালো নম্বর পেলেও ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করায় চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না। এতে ইউজিসির অবহেলা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।