মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৪, ০২:২৯ এএম
আপডেট : ০৫ জুন ২০২৪, ০৮:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শেষ সময়ে সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ছে

আগামী অর্থবছরে আরও বাড়বে
শেষ সময়ে সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ছে

বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থবছরের শেষ মাসে এসে বেড়েছে সরকারের ব্যাংক ঋণনির্ভরতা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের কারণে শুরুতে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের সমালোচনার মুখে গত আগস্টের পর আর টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার সাধারণ মানুষের সামর্থ্য ও আগ্রহ কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ পাচ্ছে না সরকার। এ কারণে ঋণের জন্য তারল্য সংকটের চাপে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে আরো বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। নতুন বাজেটে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে পুরোনো ঋণের ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মতো পরিশোধ করেছে সরকার। ফলে নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া নিট ঋণের স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় ছিল প্রায় ৬ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।

মে মাস পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছর জুন পর্যন্ত এই অঙ্ক ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।

এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি সরবরাহ করে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এর বড় অংশই নতুন টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর বাকিটা নেওয়া হয়েছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে।

চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতেই এসব ঋণ নেওয়ার শিডিউল ঠিক করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থবছরের বাকি সময়ে (চলতি জুন মাস) সরকারের ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। এভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান থেকে বঞ্চিত হয়। এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যত সম্ভব কম ঋণ নেওয়া উচিত।

সেইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে ঋণনির্ভরতা কমাতে সরকারকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে এমনিতেই চাপে রয়েছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। এখন যদি বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি সরকার বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বিনিয়োগ কম হবে, আর বিনিয়োগ কম হলে কর্মসংস্থান কম হবে। ফলে প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এমন অবস্থায় সরকারকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। সেখানেও করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো দরকার।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ নিয়ে বেশি সুদ পাচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর লাভ হচ্ছে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। সরকার ব্যাংক থেকে কম ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে আরও চাঙ্গাভাব থাকত। কিন্তু সরকারের ব্যয় অনুপাতে আয় কম। এ কারণেই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার গতি বাড়ছে। যদিও এখনো তা লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই রয়েছে।

জানা গেছে, আগামীকাল ৬ জুন অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট উপস্থাপন করছেন, সেখানেও বরাবরের মতোই বড় আকারের ঘাটতি থাকছে। আর সেই ঘাটতি মেটাতে অপেক্ষাকৃত কম সুদের বিদেশি ঋণের পরিবর্তে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি সুদের ঋণের ওপরই ভরসা করতে যাচ্ছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, সেভাবেই বাজেট ঘাটতি মেটানোর হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে এমনটি চলতে থাকায় তা দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি বেশি ঋণ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি আরও চড়ছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বারবার চাপের মুখে পড়ার কথা বলে আসছেন তারা। তবুও আয়-ব্যয়ের বিপুল ঘাটতির এমন চক্র মেনে নিয়েই বাজেট দিতে হচ্ছে সরকারকে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য কমানো, রাজস্ব আয়ের ‘লিকেজ’ কমানো, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। ঘাটতির চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট থেকেই রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার আনার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘বাজেট ঘাটতি যেন বড় না হয়, সেজন্য সরকারকে কিছু নীতি পরিবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য সরকার প্রশাসনে কিছু সংস্কার করতে পারে। যেটার মাধ্যমে ব্যয় কমানো সম্ভব। এতগুলো মন্ত্রণালয় রাখার কোনো দরকার নেই। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মতো দপ্তর রেখে বড় ধরনের ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো আস্তে আস্তে উঠিয়ে দেওয়া দরকার। একটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যে বিশাল বাহিনী, গাড়ির বহর—এগুলোর দরকার নেই।’

অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। আর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফলে বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এই ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করবে সরকার। এর মধ্যে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। বাকি ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে। এরমধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিশ্বের প্রথম ফুটবলার হিসেবে যে রেকর্ড গড়লেন রোনালদো

আবারও ইউক্রেনের যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত, পাইলট নিহত

উপদেষ্টা মাহফুজ বিএনপি থেকে নির্বাচন করবেন কি না জানালেন বাবা আজিজুর

‘ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে শিশু ছোঁয়াকে আছড়ে হত্যা করে ফুপাতো ভাই’

সড়ক পরিহার করে সভা-সমাবেশ করার অনুরোধ ডিএমপি কমিশনারের

আমরা সবাই বাংলাদেশি, এর বাইরে কোনো পরিচয় নেই : জিলানী

জামদানি পল্লী পরিদর্শনে উপদেষ্টা ফরিদা আখতার

উৎসবমুখর পরিবেশে নর্দান ইউনিভার্সিটিতে নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ

বাংলাদেশ থেকে লক্ষাধিক টাকা বেতনে নার্স নেবে কুয়েত

সংবিধানের ওপরে জুলাই সনদ প্রাধান্য পেতে পারে না : গণফোরাম

১০

ঢাবি উপাচার্যের বক্তব্য ‘বিকৃতভাবে’ উপস্থাপনের প্রতিবাদ কর্তৃপক্ষের

১১

হাজার হাজার মার্কিনি নিচ্ছেন মেক্সিকোর নাগরিকত্ব

১২

যাদের জনসমর্থন নেই, তারাই পিআর চায় : এসএম জাহাঙ্গীর

১৩

আরও একটি ট্রফি হাতছাড়া রোনালদোর

১৪

জাতীয় সনদে জনআকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে : আ স ম রব

১৫

ভালো কাজের প্রতিযোগিতার আহ্বান সাদিক কায়েমের

১৬

মানুষ কেন হাই তোলে? গবেষণায় জানা গেল নতুন তথ্য

১৭

বেগম খালেদা জিয়া আপোষহীন নে‌ত্রী : ফরহাদ মজহার

১৮

মওলানা ভাসানী সেতুর বিদ্যুতের তার চুরি, থানায় মামলা

১৯

১২ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি

২০
X