নদীভাঙনে বিলীন হয়েছিল বাবা ও শ্বশুরের ভিটাবাড়ি। সেই থেকে ভূমিহীন-গৃহহীন বিবি আয়েশা। এরই মধ্য দুই কন্যা ও চার পুত্র রেখে মারা যান স্বামী। সব কুল হারিয়ে জীবনের অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়াকেই নিয়তি মেনেছিলেন বিবি আয়েশা। কেউ পাশে দাঁড়াবেন—এ ছিল তার কল্পনারও বাইরে। কিন্তু দুস্থ নিঃস্ব সবহারা মানুষকে নিয়ে যার সব সময়ের ভাবনা, সেই শেখ হাসিনা ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন বিবি আয়েশাকে। তাকে দিয়েছেন নতুন ঘর। এ ঠিকানা ঘিরে এখন তিনি দেখছেন নতুন দিনের স্বপ্ন।
দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া বিবি আয়েশা জানাচ্ছিলেন নতুন ঠিকানা পেয়ে কীভাবে তিনি নতুন জীবন পেলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবি আয়েশা বলেন, ‘মাইনসের বাড়িতে উরকাইত থাকছি, কত কষ্ট করছি। আমাগে কেউ নাই, আল্লাহ আমাদের একজন শেখ হাসিনা দিছেন। হের বাপেও (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) আমাগে লাইগ্যা করছে, হেও (শেখ হাসিনা) করতেছে।’ তিনি বলেন, একসময় আমাগে সবই ছিল। নদী সব খেয়ে ফেলেছে। পোলাপাইনের বাপের বাড়ি ছিল আলিমুদ্দি বাংলাবাজার। আমার বাপের বাড়ি ছিল হাজীপুর। অভাবের সময়ে স্বামীও চলে গেছে। এক পোলাও মরে গেছে। দুই পোলা অন্য জায়গায় থাকে। মেয়েরা গার্মেন্টসে কাজ করে। ছোট ছেলেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘরে থাকি। এজন্য প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি। আমি যেন শান্তিমতো থাকতে পারি, সেজন্য যে ঘর দিল তার জন্য দোয়া করব না তো কার জন্য দোয়া করব।
বিবি আয়েশার মতো ভূমিহীনদের কষ্ট লাঘবে আজ মঙ্গলবার গণভবন থেকে পঞ্চম ধাপে ২৬ জেলার ১৮ হাজার ৫৬৬টি পরিবারের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় ভোলা, কক্সবাজার ও লালমনিরহাটের উপকারভোগীদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে ঘর হস্তান্তর কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন তিনি। একই সঙ্গে ৭০টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীন মুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করবেন। এর মাধ্যমে মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশকে গৃহহীন ও ভূমিহীন মুক্ত করার প্রত্যয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশ। এক ধাপ এগিয়ে যাবে এসডিজি বাস্তবায়নের পথেও।
আশ্রয়ণ প্রকল্পসূত্রে জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ে সারা দেশে ২ লাখ ৬৬ হাজার ১২টি পরিবারকে দুই শতক খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে নির্মিত গৃহ হস্তান্তর করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ইতোপূর্বে ৩২টি জেলার সব উপজেলাসহ ৩৯৪টি উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, বরিশাল, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জসহ ২৬ জেলায় ঘর হস্তান্তর করা হবে।
সরেজমিন দেখা যায়, একই আশ্রয়ণ প্রকল্পে বিবি আয়েশার মতো আরও ১৩৫টি পরিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হবে। জাহানপুরের পাঁচ কপাট আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫০টি পরিবার, পশ্চিম এওয়াজপুর ১ নম্বর ওয়ার্ড আশ্রয়কেন্দ্রে আরও ১৭৫টি পরিবার নতুন স্বপ্নে নিজেদের ঘর সাজিয়েছে। বাড়ির উঠানে লাগিয়েছে সবজি ও ফলের গাছ। লালন-পালন করছে হাঁস ও মুরগি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ভোলা জেলার বাকি ছয়টি উপজেলাগুলোকেও ভূমিহীন মুক্ত করার লক্ষ্যে চরফ্যাশন, বোরহানউদ্দিন ও মনপুরা উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষণা করা হবে। আজ এসব স্থানে ১ হাজার ২৩৪টি ঘর সরাসরি ভূমিহীনদের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ভোলা একটি নদীভাঙন কবলিত এলাকা। এখানে প্রতিনিয়ত মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ে। সেসব নিঃস্ব, অসহায় মানুষকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। মূলত এই প্রকল্পটি বিশ্বে একটি নন্দিত প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পটি যারা অসহায় নিঃস্ব মানুষ রয়েছেন, তাদের চেহারা ও আত্মবিশ্বাসকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। ভোলা জেলায় ঘরগুলো যেসব পরিবারকে হস্তান্তর করতে যাচ্ছে, সেই ঘরগুলো এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের আর্থসামাজিক উন্নতিসহ তাদের জীবনমানে উন্নয়ন ঘটবে। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষ যেভাবে উপকারভোগী হবে, তাতে আগামীর উন্নত, সমৃদ্ধ স্মার্ট ভোলা হিসেবে গড়ে উঠবে।