সম্প্রতি পৃথিবীর সর্বদক্ষিণের মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা ঘুরে এসেছেন বাংলাদেশি অভিযাত্রী মহুয়া রউফ। রোমাঞ্চকর সেই অভিযাত্রার গল্প পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো। লিখেছেন রীতা ভৌমিক ছবি রনি বাউল-
মহুয়া রউফ অনেক দিন ধরে ভাবছিলেন পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণের শেষ শহর আর্জেন্টিনার উশুইয়াতে ভ্রমণে যাবেন। এ শহরের শেষ মাথা থেকে বিশাল সমুদ্র। তখনই তার চিন্তায় এলো, উশুইয়াতেই যখন যাবেন, অ্যান্টার্কটিকায় নয় কেন?
গত বছর আর্জেন্টিনা গেলেও সময় স্বল্পতার কারণে উশুইয়াতে যেতে পারেননি। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে ১০ দিনের মতো অবস্থান করেছিলেন। প্রথমবার আর্জেন্টিনার ভিসা পাওয়ায় তিনি ভেবেছিলেন, দ্বিতীয়বার আর ভিসা নিয়ে কোনো ঝামেলা করবে না। তিনি বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আর্জেন্টিনার দূতাবাসে মেইল করেন দেশটির শেষ ভূমি দেখার ইচ্ছা জানিয়ে। উত্তর এলো, তোমার পথ এটা না। তুমি দিল্লি চলে যাও। দিল্লিতে কতদিন পাসপোর্ট রাখবে এর নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। তিনি তারপরও রাজি করানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। জানালেন, তিনি তাদের দেশ নিয়ে পত্রিকায় লিখেছেন। কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছিল না। একটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইমেইল, ফোন মারফত আর্জেন্টিনা দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। অনেক যোগাযোগের পর আর্জেন্টিনা দূতাবাসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলেন।
মহুয়া রউফ বলেন, আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ভিসা হয়ে গেল কিন্তু মজার ব্যাপার ছিল, যিনি ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন তিনি গতবারের সেই প্রধান নারী কর্মকর্তা। তিনি আমাকে দেখামাত্রই বললেন, তোমাকে আমি চিনি। তুমি বাংলাদেশের। প্রথমবার তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কেন আমার দেশে যেতে চাও?’ আমি বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ তোমাদের দেশে গিয়েছিলেন ১০০ বছর আগে। রবীন্দ্রনাথ যেখানে যেখানে গিয়েছেন, আমি সেখানে যেতে চাই। এ কথা শুনে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তোমার এত সখ্য কেন! আমি ভ্রমণকাহিনি লেখার চেষ্টা করি। তোমাদের দেশে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বলে একজন আছেন, রবীন্দ্রনাথ যার প্রেমে পড়েছেন। কিশোর বয়সে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক বই পড়েছি। ‘ওগো বিদেশিনী’ গানটা রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে অনুবাদ করে উপহার দিয়েছিলেন। তিনি একজন পরিচালককে ফোন দিয়ে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বললেন। এরপর আমাকে বললেন, তুমি কি জানো আমার দেশের একজন পরিচালক পাবলো সিজার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং রবীন্দ্রনাথের ঘটনা নিয়ে একটি ফিল্ম করেছেন। ছবিটি তুমি দেখেছ? আমি বললাম, ছবিটা সম্পর্কে আমি জানি কিন্তু দেখিনি। আমি নেটওয়াক্সে ছবিটি পাইনি। তিনি বললেন, তুমি সত্যি কথা বলেছ। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আমাকে ছবিটি দেখার জন্য মেইলে একটি পাসওয়ার্ড দেবেন। এটি যেন কারও সঙ্গে শেয়ার না করি। প্রথমবারের এ আলাপচারিতা তিনি ভোলেননি। তাই দ্বিতীয়বার তিনি আমাকে দেখামাত্রই বললেন, তুমি আবার কেন যেতে চাও। আমি বললাম, প্রথমবার সময় ও আর্থিক স্বল্পতার জন্য বুয়েনস আয়ার্সে ছিলাম। আশপাশের জায়গাগুলো দেখেছি। দেশের শেষ সীমান্ত উশুইয়া দেখিনি। তিনি বললেন, প্রথমবার খুব তো বলেছ আমার দেশ নিয়ে লিখবে। কী লিখেছ আমার দেশ নিয়ে বলো। আর্জেন্টিনার জাতীয় টেঙ্গো নৃত্য। এটি কাপল ডান্স। অর্ধ-আলিঙ্গন করে থাকবে একজন আরেকজনকে। কিছু কিছু রাস্তার কিনারে বা মাঝখানে, কিছু কিছু রেস্টুরেন্টে নাচের জন্য আয়তকার জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র মনে করে তার দেশের জাতীয় নৃত্য, যখন ইচ্ছা কাপলরা নাচতে পারেন। এরকম সংস্কৃতি চর্চা আর কোনো দেশে দেখিনি। সারগম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত টেঙ্গো নৃত্য নিয়ে লেখাটা দেখালাম। তুমি আমাকে আড়াই ঘণ্টা সময় দাও। ভিসা পেয়ে গেলাম।
পৃথিবীর পাঁচটি জায়গা থেকে অ্যান্টার্কটিকায় যাওয়া যায়। জাহাজ ছাড়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চিলি ও আর্জেন্টিনা। মহুয়া রউফ ভাবলেন, যেহেতু তিনি উশুইয়া যাবেন, সেখান থেকেই তো অ্যান্টার্কটিকার জাহাজ ছাড়ে। তবে ওখানে যাওয়ার প্যাকেজগুলো ছয় মাস বা এক বছর আগেই শেষ হয়ে যায়। টিকিট না পাওয়ার ভয়টা তাকে জেঁকে বসে। এরপর সেখান থেকে ব্রাজিল, এরপর চিলি হয়ে উশুইয়ার বিমানের টিকিট কাটেন। এরই মধ্যে অ্যান্টার্কটিকার প্যাকেজ পাওয়ার খোঁজ চালিয়ে যেতে থাকেন। সবাই না জানিয়ে দেয়। অবশেষে একটি এজেন্সি জানায়, অ্যান্টার্কটিকার একটি প্যাকেজ তাদের কাছে আছে। যদি তিনি ২০ শতাংশ টাকা দিয়ে সেদিনই বুকিং দেন, তাহলে টিকিটটা তার জন্য রাখা হবে। যেতে না পারলে এ টাকা অফেরতযোগ্য। অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে বন্ধুবান্ধব-স্বজন সহযোগিতায় তিনি টিকিট বুকিং দেন। সব মিলে তার খরচ হয়েছিল ১৫ লাখেরও বেশি।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের হোটেলে রাখা হয়। তারা ছিল জাহাজের সহযাত্রী। হোটলে রাশিয়ান নারী নাসতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। নাসতা তাকে বললেন, তুমি হবে আমার ১২ দিনের সঙ্গী। সেখানে এক রাত থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি জাহাজে উঠলেন, অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার উদ্দেশে। জাহাজে ১১৪ যাত্রী, ৭২ জন ক্রু।
জাহাজের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে মহুয়া রউফ বলেন, জাহাজে চারজন মেয়ে সহযাত্রী বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে দুজন জার্মানি, একজন টার্কিশ আর আমি। নাসতা ছিল আমার কেবিন বন্ধু। সবাই আমাদের ডাকত ‘চার সাহসী নারী’। জাহাজের অস্বাভাবিক দুলুনিতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি। এ সময় লিডার মারিওর ঘোষণা দিলেন, আমরা অ্যান্টার্কটিকা বলয়ের মধ্যে চলে এসেছি। জাহাজ নোঙর ফেলার আগমুহূর্তে সুস্থ হয়ে উঠি। যার পরনে যা ছিল সেই অবস্থায় কেবিন থেকে দৌড়ে বারান্দায় আসি। সুন্দর মনোরম দৃশ্য। পানির মধ্য থেকে ভেসে ওঠা পাহাড়। ফাটাফাটা বরফ। বড় বড় আইসবার। এ দৃশ্য দেখে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হলাম। মোবাইলে এ দৃশ্য ধারণ করলাম। কিন্তু এ আনন্দ বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারলাম না।
এ সময় লিডার মারিওর ঘোষণা দিলেন, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রথম অ্যান্টার্কটিকা অপারেশন শুরু হবে। তোমাদের নিয়ে এ, বি, সি, ডি—চারটা গ্রুপ করা হয়েছে। তোমরা কে কোন গ্রুপে দেখে নাও। অ্যান্টার্কটিকা পরিভ্রমণ যারা পরিচালনা করছিলেন তারা আগেই কয়েকটি বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অ্যান্টার্কটিকা পরিদর্শনের পাশাপাশি তারা যাতে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। অ্যান্টার্কটিকা, পেঙ্গুইন, তিমি, কী মানা হবে, কী মানা হবে না ইত্যাদি সম্পর্কে।
মহুয়া রউফ বলেন, বোর্ডে গিয়ে দেখলাম ‘এ’ গ্রুপে সবার ওপরে আমার নাম। আনন্দে মনটা ভালো হয়ে গেল। অসুস্থ হওয়ায় লেয়ারের পর লেয়ার কাপড় (পোশাক এবং অন্যান্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র স্যানিটাইজ) পরতে সহযোগিতা করলেন তারা। ১০ জন করে একটি জোডিয়াকে উঠলাম। যিনি গাইড করছেন তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। উত্তাল সমুদ্রের ওপর দিয়ে ছোট প্লাস্টিকের নৌকায় চড়ে প্রথম কিউভার ভ্যালি আইল্যান্ডে গেলাম। পাহাড় আর পেঙ্গুইনের অভয়ারণ্য। সামনে থেকে প্রথম পেঙ্গুইন দেখলাম। দ্বিতীয় অপারেশন অনেকগুলো পাহাড় নিয়ে গড়ে ওঠা পোর্ট লকরয় আইল্যান্ডের পেঙ্গুইন পোস্ট। এই আইল্যান্ডে ব্রিটিশ, সুইডিশ অনেক বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী, গবেষকরা এখানে এসেছেন জানার জন্য। থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন ছোট ছোট ঘর। এখানে কোনো স্থায়ী বাসিন্দা নেই। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশরা এখানে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করে। বিশাল সংগ্রহশালা এটি তাদের। ১৯৯৬ সালে একটি ঘরকে তারা পোস্ট অফিস তৈরি করে নাম দেয় পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস। অভিযাত্রীরা ওই পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্টকার্ড কিনে চিঠি লিখে স্ট্যাম্প লাগিয়ে পোস্টবক্সে চিঠি ফেলে আসতে পারেন। আমি আমার দুই ছেলের জন্য দুটি চিঠি লিখে পোস্ট করে এসেছি। অ্যান্টার্কটিকা ক্যাম্পিং করার জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় একটি বরফের পাহাড়ে। অভিযাত্রীরা আয়তাকার গর্ত করে সেখানে ফোমের মতো বিছিয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর শরীর ঢুকিয়ে মুখ বের করে শুয়ে থেকে আকাশের সৌন্দর্য অনুভব করেছেন। তিমি অপারেশন ছিল আরেকটি মজার অপারেশন। এত বড় বড় তিমি ছোট ছোট জোডিয়াক দেখেও উল্টে দেয়নি।
মন্তব্য করুন