সুমাইয়া জাহান স্বর্ণা
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১০ মে ২০২৫, ০৭:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মায়ের মমতা বনাম প্রযুক্তি

মায়ের মমতা বনাম প্রযুক্তি

কবি বলেছিলেন—‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই, ইহার চেয়ে নাম যে মধুর তিন ভুবনে নাই।’ সন্তানের সঙ্গে মায়ের যে নাড়ির সম্পর্ক, সে সম্পর্ক মধুর তো অবশ্যই, একই সঙ্গে সে সম্পর্ক স্নেহের, মমতার, শ্রদ্ধার। মা শব্দটি উচ্চারণ করলেই গভীর এক আবেগ আমাদের আচ্ছাদিত করে ফেলে। সে আবেগ চিরন্তন। কিন্তু প্রযুক্তির এ যুগে একজন মায়ের সঙ্গে তার সন্তানের আবেগ-অনুভূতির সম্পর্কের গভীরতা কি আদৌ তৈরি হচ্ছে? প্রযুক্তি মায়েদের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ তাই নিয়ে লিখেছেন সুমাইয়া জাহান স্বর্ণা

আধুনিক জীবন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হলো প্রযুক্তি। প্রযুক্তির কল্যাণেই মানুষের সঙ্গে মানুষের সবরকম নিত্যনতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের। চিকিৎসা, উৎপাদন, বিপণনসহ এমন কিছু নেই, যার মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার যুক্ত হচ্ছে না। বর্তমান সময়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এ যুগে সবকিছুই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তি ছাড়া এখন মানুষ একেবারেই অচল। এ প্রযুক্তির কারণেই সন্তান পালনে আজকাল খেই হারিয়ে ফেলছেন মায়েরাও।

একসময় ছিল বিকেলের আলো গড়াতে না গড়াতেই খেলার মাঠগুলোতে ছোটাছুটিতে মেতে থাকত শিশু-কিশোররা। ফুটবল, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, মার্বেলসহ নাম না জানা কতশত বিনোদনে পূর্ণতা পেত গোধূলির সময়টা। স্কুল-কলেজে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডা, দৌড়াদৌড়ি, দুষ্টুমিই ছিল শিশু-কিশোরদের নিত্যদিনের আনন্দ। সকাল-সন্ধ্যায় গল্পের বইয়ে ডুব দেওয়া, বড়দের সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যাওয়া, প্রবীণদের কাছ থেকে গল্প শোনা ছিল তাদের কাছে এক ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা। খেলতে বা গল্প করে সময় কাটানোর ফলে দেরি হয়ে গেলে অনেক সময় মায়ের বকুনিও খেতে হয়েছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজকে যেন সবই হারিয়ে যেতে বসেছে। এসবের জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ট্যাব আর ল্যাপটপের মতো আধুনিক সব প্রযুক্তি। বর্তমান সময়ে এসব ডিভাইসের প্রতি আসক্তি এতটাই বাড়ছে যে, ইচ্ছে থাকলেও এসব থেকে নিজের সন্তানকে দূরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন মায়েরা।

অনেকটা আক্ষেপ করেই স্কুলশিক্ষিকা ইতি বলেন, বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার নিয়ে অতি ব্যস্ত হয়ে থাকছে শিশু-কিশোর, তরুণদের একাংশ। পড়াশোনা করবে ফোনের মাধ্যমে, খাবার হাতের মুঠোই পাবে ফোনের মাধ্যমে, এমনকি আত্মীয়তা রক্ষা করবে ফোনের মাধ্যমে। সন্তান পালনের জন্য প্রযুক্তি যেমন উপহার আবার কিছুটা অভিশাপও বটে। প্রযুক্তির বদৌলতে বাচ্চারা অনেক কিছু ঘরে বসেই খুব সহজে শিখে নিতে পারছে, যা তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক সময় দারুণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি অনেক সময় তাদের বিকাশে বিরূপ প্রভাবও ফেলে। এমনকি সামাজিক যে সম্পর্কগুলো রয়েছে, তা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তারা। আমরা ছোটবেলায় আমাদের নানি-দাদিদের সঙ্গে যেমন খুনসুটিতে মেতে থাকতাম, এর ধারেকাছেও আজকাল যাচ্ছে না আমাদের সন্তানরা। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের সন্তানরা যেমন যন্ত্রমানবে পরিণত হচ্ছে, ঠিক তেমনি আমরা যারা মা আছি, তারাও কেমন যেন নেশার মধ্যে ডুবে আছি। মায়ের যে মমতা সন্তানদের প্রাপ্য, তা যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। মা-সন্তানের মধ্যে যে বন্ধন, তা যেন ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে! কথায় আছে, একজন মা তার সন্তানের প্রথম শিক্ষক। আগেকার দিনে মায়েরা যেমন অবসর সময়ে গল্প করতেন, তখন সন্তান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তা শুনত। চাঁদের সেই চরকাকাটা বুড়ি যে নেই, বর্তমান শিশুরা তা বেশ ভালো করেই জেনে গেছে অল্প সময়ে। ডিজিটাল শিশুরা এক ক্লিকেই পেয়ে যাচ্ছে তাদের পছন্দের গল্প, ছড়া, কার্টুন—সবকিছুই। মায়েদের এখন আর কষ্ট করে গল্প শোনাতে হয় না। তারাও এখন মোবাইল হাতে ব্যস্ত।

একটা সময় ছিল যখন বাচ্চা খেতে না চাইলে মা তাকে গল্প শুনিয়ে খাওয়াতেন, কখনোবা ঘুম পাড়াতেন। অথচ এখনকার মায়েরা মোবাইলটা হাতে দিয়ে বাচ্চার পছন্দের যে কোনো কিছু চালিয়ে দেন, তাতেই তারা খুশি। খাওয়াও হচ্ছে, মাকে বিরক্তও করছে না। ছোট্ট শানায়ার বয়স পাঁচ বছর। এ বয়সে যেখানে খেলাধুলা-গল্প শোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল; সেখানে এখন সারা দিন শুধু ঘুম ছাড়া মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে সে। এ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছেন তার মা। অবশ্য মেয়ের এ অভ্যাসের জন্য নিজেকেই দায়ী করছেন তিনি। ছোট থেকে খাওয়ানোর সময় মেয়ের সামনে মোবাইলে কার্টুন ছেড়ে রাখতেন। মেয়ে যখন কান্নাকাটি করত তাকে শান্ত করার জন্য সামনে ধরতেন ফোন। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এখন মেয়ের এ অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারছেন না তিনি।

সব সন্তানের কাছে তার মায়ের করা রান্না অনেক প্রিয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আপনি বর্তমান শিশুদের কাছে জানতে চান তাদের প্রিয় খাবার কী? দেখবেন সেখানে ফাস্ট ফুডের নাম আসবে সবার আগে। এখন আর বিভিন্ন ধরনের রান্না করার সময় নেই। ফোনে অর্ডার করছে আর তা চলে আসছে কয়েক মিনিটের মধ্যে।

প্রযুক্তির নানা অসুবিধার পাশাপাশি কিছু সুবিধাজনক দিকও রয়েছে। আগে স্কুল পালালে বা অসুস্থতার জন্য যেতে না পারলে সেদিনের পড়াটি পরদিন স্কুলে গিয়ে তারপর সংগ্রহ করতে হতো। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকার সুবাদে খুব সহজেই দিনের পড়া দিনের মধ্যেই সংগ্রহ করে নেওয়া যায়। অনেক শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণী আছে, যারা প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিজেদের স্কিল বৃদ্ধি করছে। তৈরি করছে নতুন নতুন জিনিস।

সবশেষ এটুকুই বলা, প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রতি মা-সন্তান দুজনকেই সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে একটা সময় গিয়ে এমন হবে যে, মায়ের মমতা কী তা ভুলে যেতে বসবে সন্তানরা। পাশাপাশি মায়েরাও সন্তানদের বেড়ে ওঠার সময়টা উপভোগ করতে পারবেন না। তাই মা-সন্তান উভয়ের উচিত প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করা। না কম না বেশি!

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আ.লীগকে নিষিদ্ধ করতে সবার আগে আওয়াজ তুলেছে বিএনপি : পুতুল

ডিআইইউ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি কালাম, সম্পাদক রাকিবুল 

অপহরণকালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ, নিহত ২

ভারতের ‘ভিত্তিহীন’ দাবির জবাব দিল পাকিস্তানি বাহিনী

দেশীয় অস্ত্রসহ মৎস্যজীবী দলের নেতা গ্রেপ্তার

ভারতের ২৬ ঘাঁটিতে হামলায় করে পাকিস্তান

বৃষ্টি নিয়ে আজও রাজধানীবাসীর জন্য সুসংবাদ 

পাকিস্তানে বিস্ফোরণ, ২ পুলিশ নিহত

আজ বৃষ্টি হতে পারে যেসব জায়গায়

আজ যেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া

১০

শেষ বন্দিকে ছাড়ছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী

১১

গাজায় ইসরায়েলি বিমান ও স্থল হামলায় নিহত আরও ২৬

১২

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৩

১২ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৪

১২ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

‘যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করেনি পাকিস্তান’

১৬

‘আগামী নির্বাচনে জনগণ আ.লীগকে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করবে’

১৭

আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ নেতার মৃত্যু, বিএনপি নেতার বাড়িতে আগুন

১৮

হাসনাতকে অভিবাদন জানালেন সারজিস

১৯

‘ড. ইউনূসের প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প’ প্রচারে যা জানা গেল

২০
X