

শীত এলেই মায়ের সেই অভ্যাস—স্কুলে বেরোনোর আগে ঠোঁটে ঘি মাখানো! দোকানের লিপবাম নয়, বরং রান্নাঘরের এ প্রাকৃতিক উপাদানেই ছিল সৌন্দর্যের যত্ন। সময় পাল্টালেও এই প্রাচীন উপায় আজও সমান কার্যকর। ঘি হলো এমন এক প্রাকৃতিক উপাদান, যা ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে পুষ্টি দেয় ও কোলাজেন তৈরি করতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদে যাকে বলা হয় ‘অমৃত’, সেই ঘিই এখনো ত্বক, চুল ও ঠোঁটের যত্নে এক অনন্য উপাদান। ভাবছেন কীভাবে? সেটাই আপনাদের জানাচ্ছেন—বৃষ্টি শেখ খাদিজা
রান্নাঘরে যেসব উপাদান সবসময় পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি হলো ঘি। গরম ভাতে একটু ঘি হলে আর কী চাই বলুন। তা ছাড়া ঘিয়ে ভাজা পরোটা, হালুয়া বা খিচুড়ির স্বাদ তো অনন্য। তরকারির স্বাদ বাড়াতেও এ উপাদানের জবাব নেই। শুধু কি খাবারের স্বাদ বাড়ানো, এই দুগ্ধ উপাদানটির রয়েছে একাধিক স্বাস্থ্যগুণও। প্রাকৃতিক পুষ্টি ও ভিটামিনে ভরপুর ঘি ত্বককে করে তোলে আর্দ্র এবং পুষ্ট। শীতকালে ত্বক ও ঠোঁট ফাটলেও কিন্তু সেখানে ঘি লাগালে ময়েশ্চারাইজারের কাজ করে। ত্বকের দাগছোপ দূর করে আনে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা। ঘিয়ে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও গুড ফ্যাট। ঘি যত খাঁটি, তার উপকারিতাও তত বেশি। কেউ পছন্দ করেন গরুর দুধের ঘি, তো কেউ পছন্দ করেন মহিষের দুধের ঘি। ত্বকের যত্নে ঘি কেনো উপকারী আজ না হয় তাই জেনে নিই।
প্রাচীন ঐতিহ্যের ‘তরল সোনা’
‘ঘি’ এমন একটি শব্দ, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, চিকিৎসাশাস্ত্র ও রান্নার ইতিহাস। ইংরেজিতে একে বলা হয় clarified butter বা পরিশোধিত মাখন। এটি এক ধরনের সোনালি হলুদ আধা-তরল পদার্থ, যার রয়েছে অনন্য ঘ্রাণ ও স্বাদ। ‘ঘি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ঘৃত (ghrta) থেকে। ধারণা করা হয়, এর উৎপত্তি ভারতবর্ষে এবং এটি প্রাচীনকাল থেকেই রান্না, ধর্মীয় আচার এবং চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভারতের মানুষ একে ভালোবেসে ডাকেন তরল সোনা বা liquid gold নামে। প্রাচীনকালে যখন গরম আবহাওয়ার কারণে মাখন সংরক্ষণ করা যেত না, তখন ঘি হয়ে উঠেছিল একটি অমূল্য বিকল্প। মাখনের দুধের অংশ আলাদা করে গরম করার মাধ্যমে তৈরি এই ঘন, সুগন্ধি তরল—যার বাদামি স্বাদে মিশে থাকে খাঁটি মাখনের সমৃদ্ধি—রেফ্রিজারেশনের প্রয়োজন ছাড়াই দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যেত।
শুদ্ধ দেশি ঘি
ঐতিহ্যগতভাবে ঘি তৈরি হয় গরুর বা মহিষের দুধ থেকে। তবে আয়ুর্বেদ অনুযায়ী, গরুর দুধ থেকে তৈরি ঘিকেই বলা হয় শুদ্ধ
দেশি ঘি—অর্থাৎ pure indigenous ghee। এটি সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও উপকারী বলে বিবেচিত। ২০০৯ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, গরুর দুধ থেকে তৈরি ঘি শরীরের প্রতিটি সিস্টেমের জন্য উপকারী। আয়ুর্বেদে একে ‘অমৃত’ বা nectar বলা হয়। বর্তমানে ঘি শুধু ভারত নয়, বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্যকর চর্বির (Good Fat) উৎস হিসেবে। প্রাচীন ঐতিহ্যের এই উপাদান আধুনিক জীবনেও ধরে রেখেছে তার নিজস্ব মর্যাদা ও স্বাদ। ত্বকের যত্নে নারীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঘি ব্যবহার করে আসছেন।
ঘি: প্রাচীন উপাদানের আধুনিক জাদু
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঘরোয়া সৌন্দর্যচর্চায় ঘি একটি অপরিহার্য নাম। বৈজ্ঞানিক গবেষণা সীমিত হলেও, অসংখ্য মানুষ ঘির ব্যবহারে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার সাক্ষী। প্রাকৃতিক এ উপাদানটি শুধু রান্নার স্বাদই বাড়ায় না বরং ত্বকের জন্যও এক অমূল্য উপহার। এটি ব্যবহারে ত্বকে পাওয়া যেতে পারে নানা উপকারিতা, যেমন—ত্বককে নরম ও আর্দ্র রাখা, প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা প্রদান, দাগ ও কালচে ছোপ হালকা করা, শুষ্ক বা ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক মেরামত, ঠান্ডা-শুষ্ক বা বাতাসযুক্ত আবহাওয়ার ক্ষতি থেকে রক্ষা, ফাটা ঠোঁট সারানো, চোখের নিচের কালচে দাগ কমানো, ক্লান্ত চোখকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং ছোটখাটো ক্ষত দ্রুত সারিয়ে তোলা।
সাম্প্রতিক (২০১৯ ও ২০২০ সালের) গবেষণায় দেখা গেছে, ঘির মধ্যে রয়েছে ত্বকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নানা উপাদান। এর মধ্যে আছে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফ্যাট-দ্রবণীয় ভিটামিন, যেমন—বুটিরিক অ্যাসিড, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (এর মধ্যে অ্যারাকিডোনিক ও লিনোলেনিক অ্যাসিড উল্লেখযোগ্য), ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ‘ডি’, ভিটামিন ‘ই’, ভিটামিন ‘কে’।
ত্বক ও চুলের প্রাকৃতিক যত্নের
এক অনন্য রহস্য
ঘি, শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ায় না—এটি ত্বক ও চুলের যত্নেও এক প্রাচীন উপকারী উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আয়ুর্বেদ মতে, ঘিয়ে রয়েছে ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ই’, যা ত্বক ও চুলকে গভীরভাবে পুষ্টি জোগায়। কীভাবে? চলুন তাহলে জেনে নিই।
ত্বকের আর্দ্রতা ও মসৃণতা
ঘি একটি প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার। এর ভিটামিন ‘এ’ ও ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে দীর্ঘস্থায়ী আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ যতিন গুজরাতি বলেন, ‘ঘি ত্বককে আর্দ্র করে তোলে এবং তাতে এক ধরনের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা যোগ করে। এটি নিস্তেজ ত্বককে করে তোলে কোমল ও সুস্থ।’
ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি ও পিগমেন্টেশন হ্রাস
ঘিয়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে ফ্রি র্যাডিকেল থেকে রক্ষা করে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসজনিত ক্ষতি কমায়। নিয়মিত ঘি ব্যবহারে ত্বক পায় প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ও দ্যুতি। এ ছাড়া, ঘি কোলাজেন উৎপাদনকে বৃদ্ধি করে, যা ত্বককে করে আরও টানটান।
ত্বক মসৃণ
ঘির পুষ্টিকর উপাদান ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে সাহায্য করে, তা খাওয়ার মাধ্যমে হোক বা সরাসরি প্রয়োগের মাধ্যমে। ঘি নিয়মিত খেলে বা ত্বকে লাগালে এটি টিস্যুর গভীরে গিয়ে কোলাজেনকে শক্তিশালী করে ও ত্বকের ইলাস্টিসিটি বজায় রাখে।
ফাটা ঠোঁটের সমাধান
ঘিয়ে থাকা ফসফোলিপিডস ঠোঁটে গভীর আর্দ্রতা জোগায়। তাই ঘি প্রাকৃতিকভাবে ফাটা ঠোঁট সারাতে ও ঠোঁটকে কোমল রাখতে দারুণ কার্যকর। রাতে ঘুমানোর আগে ঠোঁটে সামান্য ঘি লাগিয়ে রাখুন। সকালে পাবেন নরম, ফাটাহীন ঠোঁট। চাইলে ঘি, মধু ও চিনি মিশিয়ে তৈরি করতে পারেন প্রাকৃতিক লিপ স্ক্র্যাব—মিনিট কয়েক ম্যাসাজ করে ধুয়ে ফেললেই ঠোঁট হবে উজ্জ্বল ও মোলায়েম।
চুল ও মাথার ত্বকের যত্ন
ঘি চুলের পুষ্টির জন্যও দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এতে থাকা ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ই’ চুলকে করে নরম ও মসৃণ আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মাথার ত্বক থেকে টক্সিন দূর করে চুলে আনে হালকা, প্রাণবন্ত উজ্জ্বলতা।
ঘি খাওয়ার উপকারিতা
ঘি ত্বকের যত্নে বাহ্যিকভাবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু জানেন কি, ঘি খাওয়ার মাধ্যমেও ত্বককে ভেতর থেকে উজ্জ্বল ও সুস্থ রাখা সম্ভব।
ভেতর থেকে ত্বকের পুষ্টি
ঘিয়ে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড। নিয়মিত পরিমাণমতো ঘি খেলে এটি শরীরের ভেতর থেকে ত্বককে পুষ্ট করে, শুষ্কতা কমায় আর ত্বকে এক প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা নিয়ে আসে। ঘিয়ে থাকা ভিটামিন ‘কে’ শরীরে কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে, যা ত্বককে টানটান রাখে ও ঝুলে পড়া রোধ করে।
প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার
ভিটামিন ‘এ’ ঘির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে ও ত্বককে নরম ও মসৃণ করে তোলে। নিয়মিত ঘি খেলে ত্বকের রুক্ষতা ও খসখসে ভাব অনেকটাই কমে যায়।
গরুর দুধের তৈরি ঘি: ফ্যাট নয়, ফিটনেস
গরুর দুধে তৈরি ঘিয়ে আছে Conjugated Linoleic Acid (CLA)—এটি শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে ও পেশি দৃঢ় করতে সহায়তা করে। ফলে শরীর যেমন ফিট থাকে, তেমনি ত্বকও হয়ে ওঠে দীপ্তিময়।
ঘির প্রকারভেদ
ঘিরও আছে নানা ধরন—গরুর দুধের ঘি, ভেড়ার দুধের ঘি, ছাগলের দুধের ঘি, মহিষের দুধের ঘি ও ভেগান ঘি।
সবচেয়ে প্রচলিত এবং গবেষণায় বেশি আলোচিত হলো গরুর দুধের তৈরি ঘি। তবে অন্যান্য ধরনের ঘিয়েও প্রায় একইরকম উপকারিতা পাওয়া যায়।
ভেগান ঘি সাধারণত নারিকেল তেলসহ বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ তেলের মিশ্রণে তৈরি হয়। নারিকেল তেল যেমন ত্বকের জন্য পরিচিত উপকারী উপাদান, তেমনি ভেগান ঘিয়েও থাকে ত্বক উজ্জ্বল ও মসৃণ করার গুণ। কিছু ঘিয়ে আবার ভেষজ উপাদানও যোগ করা হয়, যা চিকিৎসাগত বা আয়ুর্বেদিক প্রভাবে ত্বকের যত্নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
ফেস মাস্ক
উপকরণ: ২ টেবিল চামচ ঘি, ২ টেবিল চামচ বেসন ও এক চিমটি হলুদ।
প্রণালি: ঘি, বেসন এবং হলুদ একসঙ্গে মেশান। পরিষ্কার, শুকনো মুখে লাগান। ২০ মিনিট রেখে দিন। কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
ময়েশ্চারাইজার
উপকরণ: ২ টেবিল চামচ ঘি, ২ টেবিল চামচ অ্যালোভেরা জেল।
প্রণালি: ঘি খুব কম আঁচে গলিয়ে নিন। আঁচ থেকে নামিয়ে অ্যালোভেরা জেল মেশান। ঠান্ডা হলে পরিষ্কার, শুকনো মুখে লাগান। ১০-১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে নিন।
হাতের ক্রিম
উপকরণ: ২ টেবিল চামচ নারিকেল তেল বা বাদামের তেল, ২ টেবিল চামচ ঘি।
প্রণালি: ঘি এবং নারিকেল/বাদামের তেল ভালোভাবে মেশান। হাতে লাগিয়ে নরম ও মসৃণ ত্বক উপভোগ করুন।
লিপবাম
উপকরণ: ১ চা চামচ ঘি।
প্রণালি: আঙুল দিয়ে ঘি নরম করুন। সরাসরি ঠোঁটে লাগান।
লিপ স্ক্র্যাব
উপকরণ: ১ চা চামচ ঘি, ১ চা চামচ চিনি ও ১ চা চামচ মধু।
প্রণালি : সব উপকরণ মেশান। ঠোঁটে বৃত্তাকার ঘষে স্ক্র্যাব করুন। ধুয়ে নিন বা নরম কাপড় দিয়ে মুছুন। শেষে একটি স্তর ঘি দিয়ে ময়েশ্চারাইজ করুন।
বডি বাটার
উপকরণ: ১ টেবিল চামচ ঘি, ২ টেবিল চামচ নারিকেল তেল ও ১ টেবিল চামচ শিয়া বা কোকো বাটার।
প্রণালি: সব উপকরণ মিশিয়ে মসৃণ পেস্ট তৈরি করুন। ত্বক, হাত, হাঁটু ও কনুইয়ে বৃত্তাকারভাবে লাগান।
ব্যবহারে সতর্কতা
গরুর দুধের ঘি ব্যবহার: সব ধরনের ত্বকের জন্য গরুর দুধের ঘি বেশি উপযোগী, কারণ এটি হালকা এবং সহজে ত্বকে মিশে যায়।
মহিষের ঘি এড়িয়ে চলুন: মহিষের ঘি ভারী হওয়ার কারণে এটি তৈলাক্ত বা সংবেদনশীল ত্বকের জন্য উপযুক্ত নয়।
তৈলাক্ত এবং সংবেদনশীল ত্বকে কিংবা ত্বকের কোনো চিকিৎসা চললে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে মুখে ঘি ব্যবহার করবেন না।
মন্তব্য করুন