আন্দোলন-সংগ্রামসহ পৃথিবীর সব লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুরুষের পাশাপাশি অবদান ছিল নারীদের। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেছে সর্বত্র। কোথাও কোথাও আন্দোলনে ৬০ শতাংশই ছিলেন তরুণীরা। তাদের অগ্নিরোষে কাঁপতে দেখা গেছে, দুঃখে কাঁদতে দেখা গেছে। সহযোদ্ধার চরম দুঃসময়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পিছপা হননি ২০২৪-এর নারীরা। প্রতিবাদী কণ্ঠ ছাড়তে ছাড়তে রাজপথে নেমে এসে পুরুষের পাশাপাশি আহত বা নিহত হয়েছেন তারা। বলা যায়, এ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে আরও বেগবান ও গতিময় করতে ভূমিকা রেখেছেন নারী শিক্ষার্থীরা। বলাবাহুল্য আন্দোলনের গতিমুখ নির্ধারণ করেছেন তারা। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি। ফলে এ আন্দোলনে হামলা, নিপীড়ন ও আটকের শিকারও হয়েছেন নারী শিক্ষার্থীরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেসব নারী শিক্ষার্থী অগ্রভাগে ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের নারী উমামা ফাতেমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের এ ছাত্রী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী এই আন্দোলনের শুরু থেকে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৯ জন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের একজন নাজিফা জান্নাত। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে। যার শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন ঘিরে। এ আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি শাখার সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত।
মোসা. আয়শা আক্তার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এর বেগম বদরুন্নেসা কলেজের সমন্বয়ক। বাবা-মায়ের আদেশ উপেক্ষা করে আন্দোলনে অংশ নেওয়া সহজ ছিল না তার জন্য। কেননা অন্যান্য বাবা-মায়ের মতো তার অভিভাবকও চাননি তাদের সন্তান আহত হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকুক কিংবা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ুক। কিন্তু বিবেকবোধ এবং নৈতিক জায়গা থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারেননি আয়শা। ১৫ জুলাই ভিসি চত্বরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হয়ে দুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল তাকে।
শাহিনুর সুমি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এর ইডেন কলেজের সমন্বয়ক। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি সুমিকে। মেয়েকে কোনো বাধা না দিয়ে বরং সমর্থন করে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পূর্ণ সম্মতি দিয়েছিল তার পরিবার।
আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সহায়তা ও মানসিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন অনেক নারী। ধানমন্ডিতে বাসার গ্যারেজে আহত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া দুই চিকিৎসক অর্থী জুখরিফ ও হৃতিশা আক্তার। অন্যদিকে নারীরা তাদের সন্তানদের নিয়ে এসেছেন মিছিলে। শ্রাবণের প্রখর রোদ বা বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত সন্তানদের পানির বোতল কিংবা খাবার এগিয়ে দিয়েছেন তারা। পাহারা দিয়েছেন। পুলিশের সঙ্গে লড়েছেন, মার খেয়েছেন, আহত হয়েছেন, ছিনিয়ে এনেছেন সহপাঠী কিংবা ভাইকে। দাঁড়িয়ে পড়েছেন পুলিশের গাড়ির সামনে। এ এক দারুণ উদাহরণ। সন্তান যখন প্রখর রোদে তাদের দাবি নিয়ে আওয়াজ তুলছিল তখন তাকে নজরদারিতে রেখেছিলেন মা। যখন কিশোর-কিশোরী আর তরুণদের লেটারিং, গ্রাফিতি আঁকা বা ছবি তুলছিলেন তখন দুহাতে পানির বোতল নিয়ে নিজের সন্তানের পাশাপাশি তার সঙ্গে থাকা বন্ধুদের দিকেও এগিয়ে দিয়েছিলেন মায়েরা। আশপাশে তাকিয়ে পুলিশের গতিবিধির দিকেও নজর রেখেছিলেন তারা। যেন সন্তাদের দিকে কোনো বিপদ আসার আগে তাকে সাবধান করে দিতে পারেন মা। এই মা আসলে কী চেয়েছিলেন? সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ? উত্তর হয়তো হ্যাঁ। প্রত্যেক মা-বাবাই চান তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক। সন্তানরা থাকুক দুধে-ভাতে। তাই হয়তো তিনি সন্তানের মিছিলে যাওয়ায় বাধা দেননি।
শুধু মায়েরা নন, নারী শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, উদ্যোক্তাদের দেখেছি। নারী সাংবাদিকদের দেখেছি। সবার একটিই চাওয়া ছিল—যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রবাসীরা যাদের থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছেন, তাদের মধ্যে দাতাদের বেশিরভাগই ছিলেন নারী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী আহত হয়েছেন। উত্তরায় বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ নাঈমা সুলতানার (১৫) মা আইনুন নাহার, প্রবীণ নারী মাসুরা বেগম, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শামীমা সুলতানা, শ্রমজীবী নারী সামিনা ইয়াসমিন, নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিন, ‘চব্বিশের উত্তরা’ সংগঠনের প্রতিনিধি সামিয়া রহমান প্রমুখ।
এই অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন রিয়া গোপ, নাঈমা সুলতানা, লিজা আক্তার, মায়া ইসলাম, মেহেরুন নেসা, নাজমা বেগম, তানহা, সুমাইয়া আক্তার, নাফিসা হোসেন মারওয়াসহ কয়েকজন নারী।
মুক্তির আন্দোলনে নারীর সক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশে নতুন নয়। এমনকি বাংলাদেশের জন্মেরও আগে যত বিপ্লব, যত গণঅভ্যুত্থান, যত স্বাধীনতা আন্দোলন এ অঞ্চলে হয়েছে, তার সবখানেই নারীর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। দেশের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে, প্রাণের তাগিদে নারী বারবার রাজপথে নেমে এসেছে।