ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শনিবার (২ আগস্ট) ‘শিক্ষার্থী-শ্রমিক ও জনতার দ্রোহযাত্রা’ শীর্ষক সমাবেশে জুলাই বিপ্লবের শহীদ মিরাজ হোসেনের ছবি হাতে তার বাবা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার পেছনে থাকা ব্যাকস্টেজ বা পর্দায় লেখা ছিল—‘জুলাই বিক্রির জন্য নহে’। মনে পড়ল সমীর রায়ের লেখা এবং প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুর ও গায়কিতে সাড়াজাগানো একটি গণসংগীতের কথা, যার মধ্য ও শেষ ভাগে বলা হয়েছে—‘...কলা বেচো, কয়লা বেচো, বেচো মটরদানা, বুকের জ্বালা বুকেই জ্বলুক, কান্না বেচো না। ঝিঙে বেচো পাঁচ শিকেতে, হাজার টাকায় সোনা, বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না...’। জুলাই ২০২৪-কে ঘিরে আমাদের কান্না ও স্বপ্ন ছিল। একজন শহীদ জুলাইযোদ্ধার বাবার পেছনে জুলাই বিক্রি সংক্রান্ত এমন লেখা নতুন করে কাঁদিয়েছে অনেককে, অনেকে হয়েছেন স্বপ্নহারা।
এ বছর জুলাই শেষে মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েকবার একটি ভিডিও দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে এ জাতির। এতে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে একটি বসার ঘরে সোফায় উপবিষ্ট দুজন তরুণের হাতে শপিং ব্যাগে কিছু একটা হস্তান্তরের দৃশ্য দেখা যায়। পরে খবর শুনে এবং পত্রপত্রিকায় খবর পড়ে জানা গেল—তা ছিল একটি চাঁদাবাজির বাস্তব দৃশ্য, যা সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়েছে। এই চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিয়েছেন রিয়াদ নামের এক তরুণ, যিনি গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ আন্দোলন দমাতে জুলাই-২৪ জুড়ে তৎকালীন সরকার ও তার পেটুয়া বাহিনী কতটা নির্মম পথ বেছে নিয়েছিল, তা সবারই জানা। ধারণা করা যায়, সেই সময় রিয়াদ ও তার সহযোগীরা রাজপথে ছিলেন এবং তাদের সামনেই বহু তরুণের বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। তারাই হয়তো শত শত হতাহত আন্দোলনকারীকে রাজপথ থেকে সরিয়ে পেছনে নিয়েছেন এবং চিকিৎসা দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন।চব্বিশের জুলাইয়ে যে হাতে তারা রক্তে ভেজা তরুণ-তরুণীদের মৃত কিংবা আহত দেহ টেনে নিয়ে গেছেন, সেই হাতেই পঁচিশের জুলাইয়ে এভাবে চাঁদার টাকা গ্রহণের দৃশ্য দেখাটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তাই ঘটনাটা বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে, যা নিয়ে গোটা জাতিকেই ভাবতে হবে।
চব্বিশের জুলাই আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের মূলে ছিল বৈষম্যহীন সমাজ তথা বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকার।একমাত্র শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছাড়া এ দেশে যারা যখন যেভাবেই ক্ষমতায় গেছেন, তারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বলেই ইতিহাস ও প্রকাশিত একাধিক সংবাদ সাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর জুলাই মাস থেকে নতুন অর্থবছরের সূচনা হয়। এই জুলাইয়ের আগে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব উৎস ও আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে যে বরাদ্দের পরিমাণ এবং সেই বরাদ্দ দিয়ে যতজনকে দরিদ্রমুক্ত করা হয়েছে মর্মে সরকার এবং এনজিওগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ও স্মার্ট পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে দাবি করে, তা যদি সত্যি হতো, তবে বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, শহর-বন্দর, গ্রাম, হাট-বাজার কিংবা বস্তিতে এত দরিদ্র মানুষের দেখা মিলত না। থাকত না গরিব ও ধনীর মধ্যে এত বৈষম্য। দরিদ্র মানুষের কাছে একটি চাকরি বিশেষত সরকারি চাকরি তাই পরমকাঙ্ক্ষিত সোনার হরিণে পরিণত হয়।বৈষম্যহীন সমাজে একটি চাকরির জন্য হয়তোবা এতটা বেপরোয়া হতে হতো না তরুণ সমাজকে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০০৮ থেকে ২০২৪-এর জুলাই পর্যন্ত মেয়াদে সরকারি চাকরিতে কোটার নামে মেধার বদলে শুধু দলীয় বিবেচনায় লোকদের ঠাঁই হয়েছে।দলীয় লোকেরা আবার চাকরি প্রদান বা সুপারিশ করার নামে প্রচুর টাকা নিয়ে গরিবকে আরও গরিব করে ছেড়েছেন। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিশেষত নিত্যনতুন গজানো তথাকথিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগবাণিজ্য ও আত্মীয়করণ ছিল ওপেন সিক্রেট। এমন বৈষম্যের বিরুদ্ধে মূলত গর্জে উঠেছিল জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধারা। পরিতাপের বিষয়, আজ রাজনীতির প্রশ্নে তারা বিভক্ত। সংস্কারের প্রশ্নে বিভক্ত। সংবিধানের প্রশ্নে বিভক্ত। নির্বাচনের প্রশ্নে বিভক্ত। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে পাঁচতারকা হোটেলের কক্ষ দখলের অভিযোগ।আবার কারও বিরুদ্ধে হাসপাতালের কেবিন কিংবা ওয়ার্ডের শয্যা দখলের অভিযোগ। সবার একটাই পরিচয়—তারা জুলাইযোদ্ধা।
তবে জুলাইকে সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছে তথাকথিত চাঁদাবাজরা। দেশে মাঠপর্যায়ে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সদস্যরা ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার বা তাৎক্ষণিক বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে মোতায়েন রয়েছেন। অতীতে সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে আর যাই হোক, অন্তত চাঁদাবাজির সাহস দেখাত না কেউ। কতিপয় বিপথগামী সিনিয়র সেনা অফিসার জুলাই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছিল। যার জেরে কখনো সেনানিবাস উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি আবার কখনোবা সেনাবাহিনী প্রধানকে টেনে নামিয়ে দেওয়ার হুংকার শুনতে হয়েছে। একদিকে পুলিশের ইমেজসংকট ও সাংগঠনিক দুর্বলতা আর অন্যদিকে অতীতের সব রেকর্ড ব্রেক করে সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনী প্রধানকে নিয়ে বিষোদগার সুযোগসন্ধানী চাঁদাবাজদের সামনে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির পথ খুলে দিয়েছে। তাদের একটাই পরিচয়—তারা জুলাইযোদ্ধা। এভাবে জুলাইকে বিক্রি করে আখের গোছাচ্ছেন অনেকেই। রিয়াদ ও সঙ্গীরা হয়তো তাদেরই একটি প্রতিচ্ছবি।
জুলাই-পূর্ববর্তী সময়ে একটি দল আর চেতনার নামে চলত চাঁদাবাজি। একই বাজার-ঘাট, রাস্তার মোড় আর টেম্পো কিংবা অটোস্ট্যান্ডে দণ্ডায়মান নিত্যনতুন চাঁদাবাজ। তাদের একটাই পরিচয়, একটাই দাবি, তারা জুলাইযোদ্ধা কিংবা জুলাই চেতনায় উজ্জীবিত সিপাহসালার। কাফি হাউস শীর্ষক গানে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় মান্না দে গেছিলেন—‘সেই সাতজন নেই আজ, টেবিলটা তবু আছে, সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই। একই বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালী নেই। কত স্বপ্নের রোদ উঠে এই কফি হাউসে, কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়। কতজন এলো গেল, কতজনই আসবে, কফি হাউসটা থেকে যায়।’ মনে দুঃখ নিয়ে আজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে লিখতে হচ্ছে যে, চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো একদিন গাইবে—‘জুলাইযোদ্ধারা নেই আজ, জুলাই তবু আছে, চাঁদাবাজরা থেমে নেই, একই ঘাটে মাঠে এসেছে নতুন চাঁদাবাজ, বৈষম্যহীনতার মানে নেই। কত স্বপ্ন ছিল এই জুলাই ঘিরে, কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়। কতজন এলো গেল, কতজনই আসবে, চাঁদাবাজরা শুধু থেকে যায়।’
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কালামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন