আজ বিশ্ব সংগীত দিবস। দিনটি উদযাপনে ভারতে যাচ্ছেন সংগীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণব। অন্যদিকে বাংলা সংগীতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে কোক স্টুডিও বাংলা। তাদের হাত ধরে ফিরে আসছে যেমন প্রাচীন ঐতিহ্য, তেমনি উঠে এসেছে দারুণ কিছু গান। সংগীত প্রযোজক হিসেবে যার নেতৃত্বও সামলাচ্ছেন অর্ণব। তারাবেলার আয়োজনে কথা বলেছেন এ তারকা। লিখেছেন ওয়ালিউল বিশ্বাস-
শুরুটা ২০২২ সালে। ভাষার মাস। নতুন উন্মাদনা নিয়ে সামনে আসে কোক স্টুডিও বাংলা। কেমন গান হবে, কী হবে—এ নিয়ে সোশ্যাল মাধ্যমে বিস্তর আলোচনা। শুরুতে স্টুডিওর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় থাকা গ্রে ঢাকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাউসুল আলম শাওন বললেন, ‘আমরা ভারত ও পাকিস্তানে কোক স্টুডিও দেখেছি। কিন্তু এবার আমরা এর মধ্যে আমাদের মিষ্টি ভাষার গান করতে পারব।’
দিন গেল, কখনো হয়েছে সমালোচনা, কখনো প্রশংসা। পুরো আয়োজনে অর্ণবের নেতৃত্বে সংগীত পরিচালনা করেন তার বন্ধুরা। অম্লমধুর অভিজ্ঞতা থাকলেও অনেকটা সফলভাবে শেষ হয় প্রথম সেশন। তবে গানের ফিউশন নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেল। দেশবরণ্য গীতকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের মন্তব্যটা ছিল এমন, ‘পুরোনো গানকে ফিউশন করার চেয়ে নতুন কিছু তৈরির কৃতিত্ব বেশি। তাদের সেটা করে দেখাতে হবে।’
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় ‘কোক স্টুডিও বাংলা’র দ্বিতীয় সিজনের প্রচার। এবার সংগীতের দায়িত্বে অর্ণব। এর প্রথম গান ‘মুড়ির টিন’। একটানেই যেন সুর খুঁজে পায় কোক স্টুডিও বাংলা। শ্রোতা-দর্শকের মন জিতে নেয়। সবার প্রত্যাশার পারদও উঁচুতে ওঠে। এরপর ব্যান্ড ‘মেঘদল’ ও জহুরা বাউলকে নিয়ে তৈরি হয় ‘বনবিবি’। ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হলেও আমজনতার মাঝে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
কিন্তু তৃতীয় গানে এসেই বড় ধাক্কা খেল এ সিজন। প্রকাশ করা হয় ‘নাহুবো’ শিরোনামের গানটি। হাজং ভাষায় এটি গেয়েছেন অনিমেষ রায়। যিনি প্রথম সিজনের প্রথম গান ‘নাসেক নাসেক’ দিয়ে বাজিমাত করেছিলেন। এবার তার সঙ্গে র্যাপশিল্পী হিসেবে পারফর্ম করেন কক্সবাজারের কন্যা ‘ডটার অব কোস্টাল’ নামে পরিচিত সোহানা রহমান। কোক স্টুডিও বাংলা বলা হলেও অন্য ভাষার গানগুলোর আধিক্য কেন—এমন প্রশ্ন আবারও উঠতে থাকে।
তবে আলোচনা-সমালোচনা যাই হোক, বিষয়গুলোর সাড়াটা বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখছেন অর্ণব। কালবেলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, ‘দর্শকের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারছি এটা বেশ বড় বিষয়। ওদের যে রেসপন্স, সেটা আমি খুব গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ ওদের থেকেই শিখছি কোন জায়গাটা বেটার করব, আরও ভালো করব। সব মিলিয়ে সংগীতশিল্পী বা দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে, এটা দরকার ছিল।’
দ্বিতীয় সেশনে সমালোচনাটা এ পর্যন্তই। এরপর যা হয়েছে তা হলো, টুপিখোলা প্রশংসা। কাজী নজরুল ইসলামের ‘দাঁড়ালে দুয়ারে’ ও কবি জসীমউদদীনের ‘নদীর কূল’ হলো সমাদৃত। অন্যদিকে ‘দেওরা’ গান ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ হতে থাকল এর রিভিউ। এমনকি তানজানিয়ার টিকটক স্টার কিলি পলের মুখে শোনা গেল গানটি। এর ধরন ও পরিবেশনায় এতটাই মাটি ছুঁয়ে গেল যে, অনেকেই বেমালুম ভুল করলেন এটি সংগৃহীত গান ভেবে।
এর ঠিক পরেই আসে কবি জসীমউদদীনের লেখা ও সুরে ‘নদীর কূল’। এটিও বিভিন্ন দেশের ইউটিউবাররা বিশ্লেষণ করেন। গানটিতে হাজির হন অর্ণব ও বগা রিপন।
গানটি প্রসঙ্গে অর্ণবের বক্তব্য হলো, ‘প্রথম সেশনের পর দ্বিতীয় সেশনটা আরও পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। এ সেশনে আমি মহাবিশ্বের গুরুত্ব গানে খুঁজতে চেয়েছি। পঞ্চভূত হিসেবে উল্লিখিত বায়ু, জল, আগুন, পৃথিবী, মহাকাশের ধারাবাহিক যোগ্যসূত্রতা তুলে ধরতে চেয়েছি। যেমন আপনি একটি গাছ লাগান, পাশাপাশি সবই করলেন কিন্তু পর্যাপ্ত স্থান দিলেন না; তাহলে এর প্রাকৃতিক বৃদ্ধি কিন্তু হবে না। আমি সেই স্থানটিও তৈরি করতে চেয়েছি। এ গানে সবাই যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, তা সত্যিই অসাধারণ।’
কোক স্টুডিওর সবশেষ গান এসেছে দিন দশেক আগে, ‘কথা কইয়ো না’। মৈমনসিংহ গীতিকার মিশেলে এটি উপস্থাপন করা হয়। মূল গানটির গীতিকার ও সুরকার ‘সাদা সাদা কালা কালা’খ্যাত গীতিকবি হাশিম মাহমুদ।
এটিও লুফে নিয়েছে দর্শক-শ্রোতারা। গানটির কথা এতটা সহজ ও সাবলীল যে, পুরোটাই মৈমনসিংহ গীতিকা ভেবে ভুল করেছেন অনেকেই।
এটি প্রসঙ্গে অর্ণবের ভাষ্যটা এমন, “আধুনিক নাগরিক কবিদের গান-কবিতা নিয়ে আমাদের কাজ করা খুবই দরকার। হাশিম মাহমুদের এ গান আমি প্রথম শুনি ফেসবুকে। কী আদর দিয়ে গানটা গাইছিলেন, মুখের কী সরল হাসি। কী সহজ সুর আর কথা। তার একটু পরেই গাওসুল আলম শাওন ভাইয়ের ফোনকল। ‘অর্ণব, এ গান তো করতেই হবে’। সংগীত পরিচালক ইমন চৌধুরী যে কাজটা করেছেন, এ গানের সঙ্গে মৈমনসিংয়ের গীতির কথায় নিজের সুর জুড়ে দিয়েছেন। সেটা একদমই আমাদের একটা বাড়তি পাওয়া।”
এখন পর্যন্ত সাতটি গান এসেছে দ্বিতীয় মৌসুমে। আরও চারটির মতো কাজ পাওয়া যাবে এবার, জানালেন অর্ণব। তবে প্রথমের চেয়ে দ্বিতীয় মৌসুম বেশ এগিয়ে বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ এতে যেমন আছে গানগুলোর বিষয়বৈচিত্র্য, তেমনি বিভিন্ন সংগীত পরিচালক ও গীতিকারদের স্বকীয়তা। ‘মুড়ির টিন’-এ যেমন চট্টগ্রামের ছেলে রিয়াদ, দেওরায় প্রীতম হাসান, ‘কথা কইয়ো না’তে ইমন চৌধুরী। পাশাপাশি গতবারের চেয়ে এবার অনেক বেশি মৌলিক গানের কাজ হয়েছে। উঠে এসেছে অসাধারণ সব কথামালা। তাই দর্শকদের সাড়াও ছিল অন্যরকম।
অন্যদিকে আড়াই দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ার অর্ণবের। গান করছেন বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই। ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে কোক স্টুডিও বাংলাকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে অর্ণব বলেন, ‘আমি হ্যাপি এমন একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। যেখানে আমাদের দেশের মিউজিক আর্টিস্টদের নিয়ে কাজ করতে পারছি। এটা এক কমিউনিটি। যেখানে ওদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। বন্ধুত্ব হচ্ছে। খুবই ভালো লাগে।’
এই তো গেল কোক স্টুডিও বাংলার নতুন এক অর্ণবের খবর। অন্যদিকে উৎসব আমেজে মঞ্চেও পাওয়া যাচ্ছে তাকে। সঙ্গে থাকছে তার ব্যান্ড অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস। দিন কয়েক আগে ঘুরে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া। দেশের মঞ্চেও তাকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। পুরোদমে গানে ডুবে আছেন ‘খুব ডুব’খ্যাত এ তারকা। পাশাপাশি নিজের স্টুডিও কলরব নিয়েও ব্যস্ত। আজ বিশ্ব সংগীত দিবসে গাইবেন গান।
কলকাতার বিশ্ব বাংলা মিলনায়তনে আয়োজন করা হয়েছে দিবসটির বিশেষ আয়োজন। যেখানে শুধু দুই বাংলা নয়, থাকবে বলিউড অভিনেত্রী শর্মিলী ঠাকুর, গীতিকবি-চিত্রনাট্যকার গুলজারের মতো মানুষও।
আপ্লুত অর্ণব মনে করেন, বিশ্ব সংগীত দিবসে এমনভাবে রবিঠাকুরকে আনাটা তার জন্য বিশেষ। কারণ তার বেড়ে ওঠাটা কবিগুরুর শান্তি নিকেতনেই যে। দিনশেষে এ পরিচয়টাতেই যেন আশ্রয় খুঁজে পান। তবে কবিগুরুকে নিয়ে এখনো কোক স্টুডিওতে বিশেষ আয়োজন নিয়ে আসেননি অর্ণব। হয়তো এ প্রশ্নর উত্তর মেলবে ভবিষ্যতেই।
মন্তব্য করুন