অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোরবানির চামড়া নিয়ে প্রতারণা ও টালবাহানা করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন কওমি মাদ্রাসার আলেমরা। তারা বলেন, সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার পরামর্শে কোরবানির চামড়া লবণজাত করে রাখা হয়। কিন্তু সরকারের পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে মাদ্রাসাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টার অপসারণ দাবি করেন আলেমরা।
সোমবার (০১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এ দাবি করেন তারা। কুরবানির ঈদে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার পরামর্শে কুরবানির চামড়া লবণজাত করে ক্ষতিগ্রস্ত কওমি মাদ্রাসার দায়িত্বশীলদের উদ্যোগে এ সভা করা হয়।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) সহসভাপতি আব্দুল হামিদ (পীর সাহেব মধুপুর)। তিনি বলেন, চামড়া-শিল্প এ দেশের সম্ভাবনাময় প্রধান শিল্পগুলোর একটি। এটি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনেরও অন্যতম প্রধান খাত। এই খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের এক বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়-উপার্জন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার পরামর্শে গত কোরবানির ঈদে বিপুল সংখ্যক কওমি মাদ্রাসা চামড়া লবণজাত করে। কিন্তু সরকারের উদাসীনতা ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে ছাত্র-শিক্ষকদের অবর্ণনীয় কষ্ট ও পরিশ্রম বিনষ্ট হয়ে গেছে। কোরবানির লবণজাত চামড়া ন্যায্যমূল্যে বিক্রির কোনো পদক্ষেপ সরকার নেয়নি। তারা আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে একপ্রকার প্রতারণা করেছেন।
আব্দুল হামিদ সরকারের কাছে তিন দফা দাবি উত্থাপন করে বলেন, অবিলম্বে কমিশন গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যাদের অসতর্কতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে চামড়া শিল্পের বিপর্যয় ঘটেছে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট খাতে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আগামী এক মাসের মধ্যে ওই দাবি পূরণে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্তনাদ সরকারের কানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন করে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
যাদুরচর মাদ্রাসার মুহতামিম আলী আকবর কাসেমীর সভাপতিত্বে এবং ফজলুল করীম কাসেমী ও আবদুল্লাহ ফিরোজীর সঞ্চালনায় সভায় আলোচনা করেন হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী, মুফতি আব্দুল আউয়াল, মাওলানা আশিকুর রহমান কাসেমী, আফতাবনগর মাদ্রাসার মুফতি মোহাম্মদ আলী, টঙ্গী দারুল উলূমের মুফতি মাসউদুল করীম, মেরাজনগর মাদ্রাসার মাওলানা রশিদ আহমাদ, মুফতি সাঈদ নূর, মুফতি জাহিদুল ইসলাম কাসেমী, মুফতি সালাহ উদ্দিন, জামিয়া নূরিয়া কামরাঙ্গীরচরের শিক্ষক সুলতান মহিউদ্দিন, মুফতি আব্দুল বারী, মুফতি মাহবুবুর রহমান নবাবগঞ্জী, মাওলানা শরিফুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব, মাওলানা হারুনুর রশিদ, মাওলানা আনওয়ার হামিদী, মাওলানা আব্দুল জলিল প্রমুখ।
মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী বলেন, আমরা কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বৃদ্ধির জন্য অসংখ্যবার আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু বাণিজ্য উপদেষ্টা চামড়ার দাম বৃদ্ধি নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি হেফাজতের ইফতার মাহফিলে এসে চামড়ায় লবণ দিয়ে রাখার কথা বলেছেন। এটা কোনো কথা হতো পারে? তিনি কি সব মাদ্রাসায় লবণ দিতে পেরেছেন? মাদ্রাসাগুলোয় কি চামড়া রাখার পরিবেশ আছে? আমি শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টাকে বলেছি- চামড়া নিয়ে বাহানা করছেন কেনো? এতিমদের যে ক্ষতি করেছেন সেটার জবাব কি দিতে পারবেন? এই বাহানার জন্য তাদের শাস্তি পেতে হবে। আমরা বাণিজ্য উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি জানাই। সারা দেশে যতগুলো মাদ্রাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার লিস্ট করতে হবে। বিস্তারিত সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হবে। আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ আদায় করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।
অন্য বক্তারা বলেন, সরকারের টালবাহানার কারণে কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো ধ্বংসের পাঁয়তারা করা হয়েছে। এবারের অভিজ্ঞতায় আগামীতে আর আমরা চামড়া সংগ্রহ করব না। সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে আমরা বড় কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবো।
সভাপতির বক্তব্যে আলী আকবর কাসেমী বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছর ঈদুল আজহায় মোট ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু কুরবানি হয়েছে। তন্মধ্যে গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে ৪৭ লাখ ৫ হাজার ১০৬টি। চট্টগ্রাম বিভাগের মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো পৌনে ৮ লাখ চামড়া লবণজাত করেছে। যদিও বাস্তবে এর পরিমাণ অনেক বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো সরকারি ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ক্রয়কৃত লবণ দিয়ে প্রায় ৩২ লাখ চামড়া লবণজাত করেছেন। লবণজাত পরবর্তী ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় চলতি মৌসুমে মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ আড়াইশো কোটি টাকার উপরে।
এদিকে মতবিনিময় সভায় কোরবানির চামড়া লবণজাত করে ক্ষতিগ্রস্ত মাদ্রাসার পক্ষ থেকে সরকারের সাথে আলোচনা করার জন্য পীর সাহেব মধুপুরকে প্রধান উপদেষ্টা ও আলী আকবর কাসেমীকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট লিয়াঁজো কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যরা হলেন- মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী, মুফতি আব্দুল আউয়াল, মুফতি মোহাম্মাদ আলী, মাওলানা আশিকুর রহমান কাসেমী, মুফতি মাসউদুল করীম, মাওলানা রশিদ আহমাদ, মুফতি ফজলুল করীম কাসেমী, মুফতি সাঈদ নূর, মুফতি সালাহউদ্দিন ও মাওলানা হারুনুর রশিদ।
মন্তব্য করুন