শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫, ১০:১১ পিএম
আপডেট : ২২ মে ২০২৫, ১০:১৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলন অব্যাহত, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান

রাজস্ব ভবন। ছবি : সংগৃহীত
রাজস্ব ভবন। ছবি : সংগৃহীত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই ভাগ করার অধ্যাদেশ বাতিল ও চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে কর্মকর্তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বরাবর স্মারক লিপি দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২২ মে) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় গিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন তারা। প্রধান উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব স্মারকলিপি গ্রহণ করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

স্মারকলিপিতে এনবিআরের কর্মকর্তারা চার দফা দাবি উত্থাপন করেন। এগুলো হলো- এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের লক্ষ্যে জারিকৃত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করা, অবিলম্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা, রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ কর এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রস্তাবিত খসড়া ও পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামত নিয়ে উপযুক্ত ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার নিশ্চিত করা।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেন। এতে স্বাক্ষর করেন কর পরিদর্শক মুতাসিম বিল্লাহ, রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শফিউল বসর, উপকর কমিশনার শিহাবুল ইসলাম কুশল, অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা এবং কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার।

জারিকৃত অধ্যাদেশের বিষয়ে ৫টি আপত্তি জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। প্রথমত; তাদের দাবি, রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির অধ্যাদেশটি কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে গত ১২ মে মধ্যরাতে জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার আগে খসড়া অধ্যাদেশে গোপনে কাটা-ছেঁড়া করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী মহলের সুবিধামতো তৈরি করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমের প্রকৃতি অত্যন্ত বিশেষায়িত এবং আইননির্ভর। কিন্তু জারিকৃত অধ্যাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তাদের দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা ও পেশাগত দক্ষতার কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি।

তৃতীয়ত; অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত রাজস্ববিষয়ক পরামর্শক কমিটির দাখিলকৃত অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন অনলাইন-অফলাইন কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের জন্য সরকারের বিভাগ পদমর্যাদায় রাজস্ব কমিশন নামক একটি স্বাধীন ও স্বশাসিত সংস্থা গঠনের গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে মর্মে জানা গেছে। কিন্তু জারিকৃত অধ্যাদেশে পরামর্শক কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়নি।

চতুর্থত; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাঠামোগত সংস্কার সময়ের দাবি। তবে এই সংস্কার হতে হবে বাস্তবমুখী, সকল অংশীজনের মতামতভিত্তিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মানদণ্ড অনুযায়ী। তদানুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত নিয়মনীতির ভিত্তিতে রাজস্ব প্রশাসনের সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারিত হতে হবে। জারিকৃত অধ্যাদেশটি এ প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

পঞ্চমত; এনবিআর বিলুপ্ত করে সরকার অধ্যাদেশটির মাধ্যমে রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুটি বিভাগ গঠন করেছে। কিন্তু অধ্যাদেশটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, অতি সুকৌশলে রাজস্ব নীতি বিভাগ কর্তৃক রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কার্যপরিধি তৈরি করা হয়েছে।

আন্দোলনকারীরা যে ধরনের সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছেন তাতে তারা উল্লেখ করেন, প্রথমত; আমরা রাজস্ব ব্যবস্থার সামগ্রিক এবং টেকসই সংস্কার চাই। শুধুমাত্র কাঠামোগত বিভাজন নয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের যে সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান রয়েছে, যেমন রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনভিজ্ঞ নেতৃত্ব, দ্বি-স্তর বিশিষ্ট প্রশাসন, সীমিত জনবল, অপ্রতুল অবকাঠামো ও লজিস্টিকস, পরস্পরসংযুক্ত অটোমেশনের ঘাটতি, বিপুল অংকের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি ইত্যাদি জায়গাগুলোতে সংস্কার চাই।

দ্বিতীয়ত; সরকার কর্তৃক গঠিত রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির দাখিলকৃত মধ্যবর্তী প্রতিবেদনে সুপারিশকৃত মডেলকে রাজস্ব নীতি প্রণয়নের জন্য একটি রাজস্ব কমিশন এবং রাজস্ব নীতি বাস্তবায়নের জন্য পুনর্গঠিত শক্তিশালী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিবেচনায় নিয়ে দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, প্রত্যাশী সংস্থাসহ দেশের অন্যান্য অংশীজনদের সাথে আলোচনা মোতাবেক আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে সর্বজনগ্রাহ্য রাজস্ব ব্যবস্থাপনা মডেল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তৃতীয়ত; আমরা এমন সংস্কার চাই যেখানে যোগ্যতা ও পেশাগত দক্ষতার মূল্যায়ন থাকবে, আমলাতান্ত্রিকতা নয়, যোগ্যতা ও বিশেষায়িত জ্ঞান অগ্রাধিকার পাবে। চতুর্থত; আমরা চাই আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে সংগতিপূর্ণ টেকসই সংস্কার। বিশ্বের উন্নত এবং বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম স্বাধীন ও স্বতন্ত্র এজেন্সি বা সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

পঞ্চমত; আমরা একটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা চাই যেখানে তিন বিভাগ আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট এর সকল ফাংশন অটোমেটেড হবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে ইন্টিগ্রেশন থাকবে, সেই ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত থাকবে, যা রাজস্ব ব্যবস্থায় গতিময়তা, স্বচ্ছতা আনবে এবং বাণিজ্য সহজীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং সবশেষে সরকারের সর্বোচ্চ সদিচ্ছায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনা উপযুক্ত সংস্কারের মাধ্যমে আমরা অটোমেটেড, ইন্টিগ্রেটেড ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে চাই।

এদিকে গত মঙ্গলবারের আলোচনার পর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে আজ (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ২০ মে অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, সড়ক বিভাগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা, রাজস্ব নীতি সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির সদস্যরা এবং এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ১৩ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ১ ঘণ্টার বেশী সময় ধরে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জানানো হয় যে, ‘রাজস্ব নীতি সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটিসহ সকল অংশীজনের সাথে বিশদ আলোচনাক্রমে জারীকৃত অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার পর উক্ত অধ্যাদেশটি বাস্তবায়ন করা হবে।’ এমন ফলপ্রসূ আলোচনার পর যে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে তা মেনে না নিয়ে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ পুনরায় অসহযোগ আন্দোলনের যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তার কোন যৌক্তিক কারণ নেই।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এমন বক্তব্যকে প্রতারণামূলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তারা। গতকাল সন্ধ্যায় আন্দোলনরত একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে সঙ্গে বলেন, এ বিজ্ঞপ্তি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার নামান্তর। আন্দোলনকারীরা জানান, মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে আলোচনার নামে প্রহসন করা হয়েছে। সেখানে কর্মকর্তাদের কথা শোনা হয়নি। এমনকি অর্থ উপদেষ্টা শুরুতেই বলেন, যে তিনি মাত্র সাত মিনিট সময় দিতে পারবেন এবং একেক জনকে মাত্র এক মিনিট কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। কর ও কাস্টমস ক্যাডারের উদ্বেগের বিষয়গুলোকে আলোচনায় কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কাজেই অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের বিজ্ঞপ্তিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে বলে আন্দোলনকারীরা জানান এবং তারা তাদের আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণাও আসবে বলে জানান আন্দোলনকারীরা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রশিক্ষণার্থী নারীকে অপদস্থের পর ক্ষমা চাইলেন সেই কৃষি কর্মকর্তা

জাবি শিক্ষার্থীদের তথ্য ফাঁস; নেপথ্যে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক

‘ফটোগ্রাফার রাফিদের স্মরণে ফটোগ্রাফি কনটেস্ট আয়োজন করা হবে’

তেলের ডিপোর ট্যাংকে আটকে শ্রমিকের মৃত্যু

অনির্বাচিত সরকার সব কিছুর সমাধান করতে পারে না : যুবদল সভাপতি

ব্যবসায়ীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট সরকার : আইসিটি সচিব

রাজউকের সার্ভারে ঢুকে ভবনের অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিল হ্যাকার নিজেই

সরাসরি গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পেলেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউট ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা

জুলাই ঐক্যের বিক্ষোভে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন’ : নাহিদ ইসলাম

১০

এবার আসিফ ও মাহফুজের পদত্যাগ দাবি গণঅধিকার পরিষদের

১১

শীতের শুরুতে স্থানীয় নির্বাচন চায় ইসলামী আন্দোলন

১২

ডাকসুর রোডম্যাপ দাবিতে ৩২ ঘণ্টা ধরে অনশনে বিন ইয়ামিন

১৩

বই চুরির মামলায় অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার গ্রেপ্তার

১৪

বন্যা না আসতেই ধসে গেল নদী রক্ষা বাঁধ

১৫

বর্তমান পরিস্থিতিতে মির্জা গালিবের ৫ পরামর্শ

১৬

পাকিস্তানকে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করে দিচ্ছে চীন

১৭

অর্ধশতাধিক বাড়িঘর বিলীন, আতঙ্কে নদীপাড়ের মানুষ

১৮

‘কুমির ডেকে আনছেন তা আপনাদেরই খাবে’

১৯

ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর অবস্থান

২০
X