চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট এলাকার বাসিন্দা জহিুরুল হক। একটি সেমিপাকা ঘরে ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, নাতি-নাতনিকে নিয়ে থাকেন। চার দিন ধরে পানিতে ভাসছে তার ঘরবাড়ি, রান্নার হাঁড়ি-পাতিল এমনকি শোবার ঘরের চৌকিও। সেই চৌকির ওপর চেয়ার দিয়ে
টিভি-ফ্রিজের শেষ রক্ষা হয়েছে কোনোমতে। কিন্তু পানির কারণে বাসায় রান্না হচ্ছে না। খাবারের কষ্টে দিন কাটছে শিশুদের।
শুধু জহিরুল নন, গত শুক্রবার টানা চার দিনের বৃষ্টিতে ডুবে গেছে নগরের নিচু এলাকার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তা কিংবা অলিগলি। জলাবদ্ধতায় পানিবন্দি অনেকেই এলাকা ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে গেছেন। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত নানা রোগে। নোংরা পানিতে দেখা দিয়েছে চর্মরোগও।
জহিুরুল কালবেলাকে বলেন, টয়লেটেও হাঁটু সমান পানি। প্রথম দুদিন টিউবওয়েলের পানিতে ময়লা ছিল। এখন বৃষ্টির পানি জমিয়ে ব্যবহার করছি। খাবার পানি প্রতিবেশীর কাছ থেকে নিচ্ছি।
কয়েকটি প্রধান সড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও জোয়ার এলে ফের পানি ঢুকে পড়ছে। ডুবে যাওয়া এলাকাগুলোর মধ্যে শুলকবহর, চান্দগাঁও, চকবাজার, মৌসুমি আবাসিক, কাতালগঞ্জ, দুই নম্বর গেট, ফরিদার পাড়া ও বহদ্দারহাটের আশপাশের এলাকার চিত্র বেশ ভয়াবহ।
চকবাজার এলাকার আব্দুল হামিদ কালবেলাকে বলেন, অসুস্থ মাকে নিয়ে কষ্টে আছি। একটু বৃষ্টি হলেই এ এলাকা তলিয়ে যায়। এবার তো টানা বৃষ্টিতে পানি নামার লক্ষণ নেই।
ওই এলাকার চসিক পরিচালনাধীন আধুনিক চক সুপার মার্কেটটিও চার দিন ধরে পানির নিচে। নিচতলায় প্রায় ৬০টি দোকানে কোমর সমান পানি। সেখান থেকে গত চার দিনে একবারও পানি নামেনি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আক্ষেপ করে ব্যবসায়ী মো. ইউসুফ জানান, পানিতে অনেক মালপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।
এদিকে, বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সব ক্লাস ও পরীক্ষা আজ থেকে আগামী বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১০ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ডেপুটি রেজিস্ট্রার দিবাকর বড়ুয়ার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকলেও অফিস খোলা থাকবে। চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের সভাপতিত্বে উপ-উপাচার্যসহ বিভিন্ন পর্ষদের প্রতিনিধিদের সভায় ওই সিদ্ধান্ত হয়।
অন্যদিকে, নগরীর সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে আজ মঙ্গলবার। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) আওতাধীন সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই দিনে চট্টগ্রামের ১৮৩ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রমও বন্ধ থাকবে বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ।
পাহাড় ধসের আতঙ্ক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে বসতঘর ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ে একজনের সামান্য আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চবি প্রক্টর ড. মোহাম্মদ নুরুল আজিম সিকদার। জানা গেছে, আহত মো. হানিফ জীববিজ্ঞান অনুষদের কর্মচারী।
অন্যদিকে, প্রতিনিয়ত আতঙ্ক ও শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা। থাকার জায়গা না থাকায় বলার পরও যাচ্ছেন না তারা। ২০০৭ সালের পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর গঠিত হয় ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’। কমিটির বৈঠক হয়, সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পাহাড়ের কান্না থামে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
আরও পড়ুন : ঝুঁকিতে ১০ হাজার পরিবার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের গবেষণা সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ এই ৩২ বছরে কাটা পড়েছে ১৯ শতাংশ পাহাড়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য অনুযায়ী, চার দশক আগেও দুই শতাধিক পাহাড় থাকলেও এরই মধ্যে ৬০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির এ পর্যন্ত বৈঠক হয়েছে। সেখানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিবছরই বর্ষার সময় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়। মাইকিং করে সচেতন করা হয়। শুকনো খাবার থেকে শুরু করে প্রতিবেলার খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ডুবেছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও
চার দিনের টানা বৃষ্টিতে নগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ তলিয়ে গেছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। গতকাল সোমবার দুপুরে ডুবে ছিল চান্দগাঁও মডেল থানা বহদ্দারহাট এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস, চান্দগাঁও থানার নিচতলার বিভিন্ন কক্ষ এমনকি হাজতখানাও। চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, থানার আঙিনা ও ভেতরে পানি। তবে তাতে রুটিন কাজে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
জলাবদ্ধতায় ডুবে আছে চসিকের ১৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস। একই ভাবে কাতালগঞ্জ, চকবাজার, বাদুরতলা, জঙ্গিশাহ মাজার এলাকা, কাপাসগোলা, চাক্তাই, বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে খ্যাত আগ্রাবাদের বিভিন্ন অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে আছে। পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শহিদুল আলম বলেন, মৌসুমি আবাসিক, চন্দনপুরা ও ডিসি রোডের জামায়াতের অফিস-সংলগ্ন চাক্তাই খালে পরিষ্কার কার্যক্রম চালিয়েছি।
সড়কে মাছ
পাহাড় থেকে নেমে আসা এ ঢলে হাটহাজারী মহাসড়কের বড়দিঘির পাড় এলাকায় জাল দিয়ে মাছ ধরতে সড়কে নেমেছেন অনেকেই। একইভাবে নগরের অন্য সড়কেও হাঁটু-কোমর সমান পানিতে মাছ ধরতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম পতেঙ্গা আবহাওয়া কার্যালয়ের পূর্বাভাসে কর্মকর্তা সুমন সাহা জানান, সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ২১৬ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভারি বৃষ্টি হতে পারে।
মন্তব্য করুন