‘মহাসড়ক যেন মৃত্যুকূপ’— কথাটি বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহাসড়কের বেহাল দশার একটি প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দুর্ঘটনা যেন পিছু ছাড়ে না। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হচ্ছে। এই সড়কটি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এর সংকীর্ণতা, বিপজ্জনক বাঁক, অবৈধ যানবাহনের দাপট ও লবণের পানি ইত্যাদি কারণে প্রতিদিনই ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
অভিযোগ আছে, প্রতিদিন শত শত ট্রাকে লবণ পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে লবণের পানি পড়ে পিচ্ছিল হচ্ছে সড়ক। মহাসড়কটির কক্সবাজারের ঈদগাঁও থেকে চকরিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ ও পটিয়া পর্যন্ত এলাকায় লবণবাহী ট্রাক চলছে অবাধে। বেশিরভাগেরই নেই পর্যাপ্ত লবণ পানি আটকে রাখার ব্যবস্থা। এছাড়া অপ্রশস্ত সড়ক, লবণ পানিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল থাকা, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক বাঁক, ওভারটেকিং, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল, ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল ও সড়কের দুইপাশে উঁচু-নিচু অংশ থাকাসহ বেশ কয়েকটি কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের বেশিরভাগ অংশের প্রশস্ততা মাত্র ১৮-৩৪ ফুট। এতে দূরপাল্লার গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। ১৪৮ কিলোমিটার পথ বাসে যেতে সময় লাগে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা। অতিরিক্ত বাঁক, উপসড়ক থেকে যত্রতত্র ছোট বড় গাড়ি মহাসড়কে উঠে আসার কারণে সড়কটি হয়ে উঠেছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রবণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পলিথিন বিহীন ট্রাক ভর্তি লবণ পরিবহন। যেটি টেকনাফ, উখিয়া কক্সবাজার, মহেশখালী, পেকুয়া, বাঁশখালীতে উৎপাদিত লবণ। যার কারণে রাতের কুয়াশার সাথে লবণ পানি একাকার হয়ে সড়কটি মারাত্মক পিচ্ছিল করে তুলছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ১৫৮ কিমি দীর্ঘ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক।
হাইওয়ে পুলিশের ভাষ্য, চালকদের গাফিলতি, ঘুম ও বেপরোয়া গতিই দুর্ঘটনার মূল কারণ। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান। কিন্তু চালকেরা দায়িত্বশীল না হলে মৃত্যুর মিছিল থামানো কঠিন।
এ দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটির অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে মহাসড়কের হাশমতের দোকান, ঠাকুরদীঘি, উপজেলার পদুয়া, লোহাগাড়া শহর, আধুনগর, হাজি রাস্তা, চুনতি, জাঙ্গালিয়া এলাকা, চকরিয়া অংশের ইসলাম নগর ইমাম বুখারী মাদ্রাসা এলাকা, বানিয়ারছড়া ওরি আমগাছ তলা, হারবাং লালব্রীজ এলাকা আজিজ নগর, চকরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এলাকা, লক্ষ্যারচর জিদ্দা বাজার টার্নিং পয়েন্ট, মালুমঘাটের রিংভং ছগিরশাহকাটা ঢালা, ডুলাহাজারার পাগলিরবিল, খুটাখালী জাতীয় উদ্যান, নাপিত খালী, রামু রাবার বাগান।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হানিফ বলেন, কিছু এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে, সাইনবোর্ডও বসানো হয়েছে। কিন্তু চালকদের অসচেতনতা কমছে না।
হাইওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন মাসে এই সড়কে ৫৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৪০ জন নিহত এবং ৭৩ জন আহত হয়েছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অংশে ৩৭টি দুর্ঘটনায় ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাস্তার অপর্যাপ্ত প্রশস্ততা, বিপজ্জনক বাঁক এবং যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ এই দুর্ঘটনাগুলোর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গত ৩ এপ্রিল সকালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকায় ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ১১ জন। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন প্রেমা নামের এক নারী। পরে তাকে উদ্ধার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থা শুক্রবার (৪ এপ্রিল) তার মৃত্যু হয়। একই দুর্ঘটনায় প্রেমার বাবা শামীম ফকির (৪০), মা সুমি আক্তার (৩৪), দুই বোন আনিসা (১৪) ও মাত্র চার মাস বয়সী ছোট বোন, এবং খালা তানিফা ইয়াসমিন (৩৫) মারা যান।
৮ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা রাজঘাটা এলাকায় এসআই পার্কের সামনে লবণের পানিতে পিচ্ছিল সড়কে বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাইফুদ্দিন জামিল নামে এক যুবক নিহত ও তার বন্ধু রেজাউল করিম আহত হন। পরেরদিন বুধবার রাত ২টার দিকে হাসমতের দোকান এলাকায় পিচ্ছিল সড়কে সবজি বোঝাই একটি ট্রাক উল্টে যায়। এছাড়া, ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে ঠাকুরদীঘি ছগির আহমদ অটো ফিলিং স্টেশনের সামনে দুটি কাভার্ড ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত ৫ জন আহত হন।
১৪ আগস্ট রাত ১১টার দিকে উপজেলার চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মো. রাকিব (২১) ও মো. জিহাদ (২০) নামে মোটরসাইকেল আরোহী দুই তরুণের মৃত্যু হয়েছে।তাদের বাড়ি কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও সদর ইউনিয়নে।
হাইওয়ে পুলিশ জানায়, রাকিব, জিহাদসহ ছয় বন্ধু তিনটি মোটরসাইকেলে করে কক্সবাজার থেকে রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি পর্যটনকেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। লোহাগাড়ায় রাকিব-জিহাদের মোটর সাইকেলের সঙ্গে কক্সবাজারমুখী মাছবোঝাই একটি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মোটর সাইকেল থেকে দুজন ছিটকে রাস্তায় পড়ার পর একই ট্রাক আবার তাদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই দুজনের মৃত্যু হয়।
দোহাজারী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাবুব আলম কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের প্রশস্ততা অনেক কম। চন্দনাইশ থেকে লোহাগাড়া চুনতি পর্যন্ত সড়কটি খুবই সরু এবং আঁকাবাঁকা। সড়কটিতে কক্সবাজারগামী প্রচুর গাড়ি প্রতিনিয়ত চলাচল করে। তাছাড়া চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজারমুখী অনেক লোকাল গাড়ি আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এতটুকু অংশে কোনো বাস টার্মিনাল নেই। গাড়িগুলো রাস্তা সংকলনের কারণে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠায় এবং নামায়। যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা করায় সড়কে অন্যান্য পরিবহনেরও যাতায়াতে অসুবিধা হয়। মহাসড়কে থ্রি হুইলার গাড়ির দৌরাত্ম্য বেশি। এছাড়া চালকদের অসচেতনতা, অসাবধানতা, ওভারটেক ইত্যাদির কারণে দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে।
মন্তব্য করুন