সময়ের পরিক্রমায় বাংলা অঞ্চলে এসে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর শাসনামলে ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও দৃষ্টিনন্দন কিছু কাজের ছাপ রেখে গেছেন। যা পরবর্তীতে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছে। মোগল আমলের তেমনই একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার মাটিয়া গোধা গ্রামের ‘চাঁদগাজী ভূঞা জামে মসজিদ’। মসজিদের দেয়ালে লেখা নির্মাণ সাল অনুযায়ী এ স্থাপত্যের সময়কাল ৪০০ বছরের বেশি।
জানা গেছে, মোগল আমলের প্রখ্যাত ব্যক্তি চাঁদগাজী ভূঞা ছিলেন বাংলার বারো ভূঞাদের একজন। তার নাম অনুসারে এ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাচীন এ মসজিদে এখনো নিয়মিত নামাজ পড়েন মুসল্লিরা। মসজিদের অবকাঠামোও প্রায় একই রকম রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদটির এক সারিতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে, যার মধ্যে মাঝখানের গম্বুজটি আকারে বড়। মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে গম্বুজের ওপরে পাতা ও নানা নয়নাভিরাম নকশা করা হয়েছে। দরজার ওপরে রয়েছে টেরাকোটার নকশা। মসজিদের সামনের অংশে শ্বেতপাথরের নামফলকে ফারসি ও আরবি ভাষায় নানা বিষয়ে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে নির্মাণকাল ১১২ হিজরি লিখে শেষে একটি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে।
মসজিদটি দৈর্ঘ্য ৪৮ ফুট, প্রস্থে ২৪ ফুট, উচ্চতায় ৩৫ ফুট ও চার পাশের দেয়াল চার ফুট পুরু। ২৮ শতক জায়গার ওপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটি মধ্যযুগীয় রীতি অনুযায়ী চুন, সুড়কি ও ক্ষুদ্র ইট দিয়ে তৈরি। মসজিদের ছাদে রয়েছে তিনটি সুদৃশ্য বড় গম্বুজ এবং চারকোণায় ও মাঝে মাঝে রয়েছে উঁচু ও সরু আকারের আরও কয়েকটি গম্বুজ।
প্রাচীন এ মসজিদের চারপাশের দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সুনিপুণ কারুকার্য। মসজিদের মূল গেট এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন মসজিদে প্রবেশের সময় মাথা নিচু করে প্রবেশ করতে হয়। এ গেটের দক্ষিণ পাশে রয়েছে উপরে উঠার সিঁড়ি। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সেখানে উঠে পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আজান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মসজিদে প্রবেশের জন্য মোগল স্থাপত্য নিদর্শনে তৈরি কারুকার্যখচিত দরজাটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পরবর্তী কাঠের দরজা লাগানো হয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে চাঁদগাজী ভূঞার কবর। কবরটি পাকাকরণ হয়নি। মসজিদের সীমানার দুপাশে রয়েছে কবরস্থান।
হাফেজ জাবের নামে চাঁদগাজী ভূঁঞার এক বংশধর বলেন, মসজিদটি এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। এটিকে সংস্কার করলে এ জনপদের ঐতিহাসিক এ স্থাপত্য টিকে থাকবে। সর্বশেষ ১৯৯৩-৯৪ সালে এটি সংস্কার করা হয়েছিল। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে মসজিদের সংস্কারের জন্য আবেদন করছি।
জামসেদ আলম নামের আরেক বংশধর বলেন, এখানে হিজরি এক হাজার বছর পর তারিখ লেখার সময় এক হাজার অংকটি না লিখে শুধু অবশিষ্ট সংখ্যা লেখা হয়েছে। অর্থাৎ, ১১২২ সালের জায়গায় ১২২ সাল লেখা হয়েছে। এ নিয়মটি সৌদি আরবে হিজরি তারিখ লেখার ক্ষেত্রে চালু রয়েছে।
তিনি বলেন, মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। কিন্তু এখানের সড়কের বেহাল দশা। এজন্য মসজিদ ও সড়কটির সংস্কার করা জরুরি। সংস্কারের অভাবে মসজিদের দেয়াল, গম্বুজ ও ছাদ শেওলা ধরে কালো হয়ে গেছে। এছাড়া এখানে কোন সীমানাপ্রাচীর নেই। সরকারিভাবে যদি মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জেম নিয়োগসহ বিষয়গুলো নজরে নেন তাহলেই ঐতিহাসিক এ স্থাপত্য রক্ষা পাবে।
ঐতিহাসিক চাঁদগাজী ভূঁঞা মসজিদটি ১৯৮৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের গেজেটভুক্ত হয়। ১৯৯২ সালে প্রাচীন স্থাপত্য হিসেবে মসজিদের কিছু অংশের সংস্কার করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে মসজিদের কিছু সংস্কারকাজ হয়েছিল বলে মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে। তারপর থেকে অযত্নে পড়ে রয়েছে কালের সাক্ষ্য বহনকারী এ স্থাপনা।
আর্কাইভ 
| ২৮ আগস্ট ২০২৫ 
