স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একসঙ্গে অস্ত্র ধরেন রেজাউল করিম চৌধুরী ও মোহাম্মদ ইউনুছ। এরপর স্বাধীন হয় দেশ, মুক্ত হয় চট্টগ্রাম। সেই যুদ্ধ থেকে বর্তমান রাজনীতির মাঠ, এক সঙ্গেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এই দুজন। একজন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র, অন্যজন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান।
চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবনা তাদের দীর্ঘদিনের। লড়েছেন মাঠে, করেছেন সংগ্রাম। উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে জাগিয়েছেনও আশা। তাই তাদের মূল্যায়নও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ‘রক্তের দোষ দুই সংস্থায়’ প্রথম থেকেই সমন্বয়হীন তাদের কার্যক্রম। যার রেশ টানতে হয় নগরবাসীকে। বর্ষার দিনে কোমর পর্যন্ত ওঠে পানি, স্তূপ আকারে মশার কামড়ে বছরের পর বছর অতিষ্ঠ নগরবাসী। ফিরছেই না স্বস্তি। শুধু কী মশা আর পানি- নগরজুড়ে মানুষের হাহাকার, দুর্ভোগ নানা বিষয়ে। সবকিছুই মূলেই সবাই দুষছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সমন্বয়হীনতাকে। কিন্তু এবার দুই সংস্থার প্রধান দীর্ঘদিনের এক ঘরনার মানুষ হওয়ার চট্টগ্রামের উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার আভাস দেখছেন নগরবাসী।
জানা যায়, বৃষ্টি হলেই ডুববে চট্টগ্রাম- এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এটি যেন নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে ‘চাটগাঁবাসী’র অবর্ণনীয় দুর্ভোগ কোনোভাবেই শেষ হচ্ছে না। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে শুরু হওয়া এসব প্রকল্পে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের জল-ভোগান্তি দূর করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। উল্টো দিন দিন বেড়েই চলেছে ভোগান্তি। এর কারণ হিসেবে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি ও কোনো প্রকার ত্রুটি আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে ২০২১ সালের জুনে চট্টগ্রামে এসেছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ঘুরে দেখেন বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্প। ওই সময় তিনি নগরের সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তিনি বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান এবং সিটি মেয়র ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করে একটি তদারকি কমিটি গঠন করে দেন। কমিটি প্রতি মাসে প্রকল্পের কার্যক্রম ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে ওই কমিটির তেমন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শুরু থেকে কমিটি কোনো প্রতিবেদন দিয়েছিল কি না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেনি জেলা প্রশাসন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আলাদা আলাদা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। উদ্দেশ্য একই হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এ তিন সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। প্রকাশ্যে একটি সংস্থা অন্যটিকে দোষারোপ করছে আর যে যার মতো করে কাজ করছে। এদিকে নগরের নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বহু নালায় জমেছে ময়লা ও পলিথিনের স্তূপ। নালা পরিষ্কারের দায়িত্ব কার, সেটা নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে চসিক-সিডিএর মধ্যে।
এদিকে সম্প্রতি জাপানে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পের ব্যবস্থাপনা শীর্ষক এক সেমিনার। সেখানে যোগ দেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র (প্রতিমন্ত্রী) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। গেল ১ মে বিকেলে চট্টগ্রামে পৌঁছান তিনি। চট্টগ্রামে পৌঁছা মাত্রই তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ।
এ সময় চট্টগ্রাম সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে চসিক এবং সিডিএকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে প্রতিষ্ঠান দুটির সমন্বয়ের বিকল্প নেই। এ ছাড়া সিডিএ যে খাল খনন প্রকল্প করছে তা যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আসলে নগরীর মশাও কমবে।
এসময় সিডিএর নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, আমি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখব। চসিক ও সিডিএর মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকবে না, সমন্বয়হীনতা থাকবে না। আমরা দীর্ঘসময় ধরে রাজপথে একত্রে লড়েছি। দুজনের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতায় চট্টগ্রাম এগিয়ে যাবে।
বর্তমানে চলমান প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে চান মোহাম্মদ ইউনুছ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের দায়িত্বভার নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আর প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় ও স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের জন্য যেসব প্রকল্প চট্টগ্রামে বরাদ্দ দিয়েছেন সেসব চলমান প্রকল্প যাতে দ্রুত শেষ করাই আমার প্রথম লক্ষ্য। আর যদি কোনো কাজ শেষ না হয়ে থাকে কেন শেষ হয়নি এর সমাধানের পথ বের করা। পূর্ববর্তী বিজ্ঞ চেয়ারম্যানরা কী করেছেন আর কী করেননি তা বিচার বিশ্লেষণ করতে যাব না। তবে চলমান প্রকল্পগুলো শেষ করার পর আমি নতুন কিছু প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাব।
প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সিডিএনর বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। বলা হয়ে থাকে, সংস্থাটি মানুষের গুরুত্বকে প্রাধান্য না দিয়েই নিয়েছিল নতুন নতুন প্রকল্প। পরে যা তদারকি করেই পারছিল না সংস্থাটি। এবার ঠিক কোনো পথে হাঁটবে তারা?
নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, এই নগরে যারা বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সময়পোযোগী যেসব প্রকল্পের প্রয়োজন হবে সেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। পরিকল্পিত আবাসন নিশ্চিতের এবং পরিবেশ সহায়ক একটি শহর গড়ে তুলতে কাজ করব।
মন্তব্য করুন