মো. আবুল হাসেম, মাটিরাঙ্গা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৩, ০৭:৪৭ এএম
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৩, ০৮:০৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

শাইখ সিরাজের ভিডিও দেখে সৌদি খেজুর চাষ, ভাগ্যবদল তরুণের

কৃষি উদ্যোক্তা নুর আলমের বাগানে ঝুলছে বিদেশি খেজুর। ছবি : কালবেলা
কৃষি উদ্যোক্তা নুর আলমের বাগানে ঝুলছে বিদেশি খেজুর। ছবি : কালবেলা

সবুজে ঘেরা উঁচুনিচু পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে চলা পথ, দৃষ্টিনন্দন অবারিত সবুজের হাতছানি, পাখ-পাখালির কলরবে মুখরিত চারদিক, কোথাও বন্যপ্রাণীর বিচিত্র ডাক। এমনি বনে-বাদাড়ের নিস্তব্ধতায় মন ছুঁয়ে যায়। বলছিলাম পাহাড়ের ডালে বিশালাকার একখণ্ড জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি খেজুরসহ বিভিন্ন জাতের ফলের বাগান করে স্বাবলম্বী হওয়া এক তরুণ কৃষি উদ্যোক্তার কথা।

মাটিরাঙ্গা সদর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার আঁকাবাঁকা মেঠোপথ বেয়ে রসুলপুর নামক এলাকায় গভীর অরণ্য ভেদ করে বিশালাকার কয়েক খণ্ড জমিতে গাছে গাছে বিদেশি খেজুর ঝুলে আছে। দেখতেই যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। দেশের মাটিতে পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি খেজুরের চাষ করে সফলতার মুখ দেখছেন মো. নুর আলম। একইসঙ্গে একই জমিতে ড্রাগনসহ বিভিন্ন মিশ্র ফলের গাছ লাগিয়ে সফলতা পেয়েছেন তিনি। পাহাড়ের মাটিতে বিদেশি জাতের এই খেজুর চাষের সফলতায় এখানকার কৃষকদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ।

আরও পড়ুন : সুন্দরবন উপকূলে লবণাক্ত জমিতে সৌদি খেজুর চাষ!

শাইখ সিরাজের কৃষি বিষয়ে অনুষ্ঠান দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এই অঞ্চলে কৃষির বিপ্লব সৃষ্টি করার আগ্রহে সবুজ পাহাড়ের ২০১৯ সালে ১৩ একর জমি ক্রয় করেছেন নুর আলম। ক্রয়পূর্বক জমি প্রস্তুত করে একই বছর থেকে মিশ্র ফলের বাগান শুরু করেন তিনি। বর্তমানে প্রায় ১০ জন শ্রমিক দৈনিক এই বাগানে কাজ করে। দুর্গম হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সাড়ে ৬ হাজার ওয়াটের সোলার সিস্টেম চালু করা রয়েছে, যা দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা সম্পূর্ণ মিটে গেছে।

নুর আলম দীর্ঘ বছর ধরে আইটি সেক্টরে সৌদি বাংলাদেশে কাজ করতেন। থাকেন ঢাকার শ্যামলীতে, দাম্পত্য জীবনে তিনি বিবাহিত ও একটি কন্যাসন্তানের জনক। আত্মীয়তার সম্পর্কের সূত্র ধরে পাহাড়ে এসে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান তিনি। মাটিরাঙ্গা কৃষি বিভাগের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে শুরু হয় পাহাড়ের জমিতে পরিকল্পনানুযায়ী বিভিন্ন ফল তথা খেজুরের চাষ।

উষ্ণ আবহাওয়া ও রুক্ষ মাটিতে অর্থকরী ফসল হিসেবে চাষ হচ্ছে মরুর সৌদি খেজুর। অন্যান্য ফলের চেয়ে এর সংরক্ষণকাল, চাহিদা ও বাজারমূল্য বেশি বিধায় এসব অঞ্চলে খেজুর চাষে আগ্রহ হচ্ছেন অনেকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রায় ১০০ আল রাজি টিস্যু কালচার সৌদি আরব ও ইংল্যান্ড থেকে এনে রোপণ করেন নুর আলম। এর আগে এই মাটি খেজুর চাষের জন্য উপযোগী কি না, সয়েল টেস্ট করিয়েছেন তিনি।

খেজুর গাছের প্রধানত রোগ হলো ছত্রাক। ছত্রাক থেকে বেঁচে গেলে একটি খেজুর গাছ প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত ফল দিতে পারে।

মাত্র দুই থেকে তিন বছরে খেজুরের বাগানে পানি, গাছ পরিষ্কার ও বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে সঠিক সময়ে নুর আলমের বাগানের খেজুর গাছে ফল ধরা শুরু হয়েছে। গাছে গাছে সবুজ, হলুদ ও লালচে খেজুরের সুবাস ছড়াচ্ছে। থোকায় থোকায় দুলছে খেজুর। এ যেন অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। কারণ মাটিরাঙ্গায় এই প্রথম পাহাড়ের মাটিতে বিদেশি খেজুরের চাষ। এ খবর চারদিকে প্রকাশ হতেই প্রতিদিন অনেকেই খেজুরের বাগান দেখতে আসেন এখানে। শখের বশে নিজ হাতে গাছ থেকে সংগ্রহ করে খেজুর কিনছেন অনেকে, খেজুর গাছের খেজুর দেখার সঙ্গে প্রকৃতির দর্শন এ যেন বিনোদনের এক নতুন মাত্রা যোগ হল। তাছাড়া খেজুরের বাগানে আশপাশের প্রকৃতি এত সুন্দর! যা কোনো প্রকৃতিপ্রেমী কবির ভাষায় বর্ণনা শোভা পেত।

আরও পড়ুন : পরিত্যক্ত ইটভাটায় বিদেশি ফল চাষ

তার বাগানে এখন বারোহি, আজওয়া, মিটজল ও আম্বারসহ বিভিন্ন জাতের খেজুরের জাত রয়েছে তাতে প্রায় অর্ধেক গাছেই ইতিমধ্যে ফল ধরা শুরু হয়েছে। আগামী দেড় দুই বছরে মধ্যে বাকি সব গাছে ফল ধরতে শুরু করবে বলে জানান তিনি। এ বছর প্রায় দুই লাখ টাকার খেজুর বিক্রির আশা করা হলেও আগামীতে ফলন ভালো হওয়া সাপেক্ষে বিক্রি আরও বেশি হবে বলে আশা করেন তিনি।

এ ছাড়া এই স্থানে খেজুরের টিস্যু কালচারের চারা বিক্রি করা হয় বলেও তিনি জানান।

এদিকে এ বাগানে চাইনিজ কমলা গাছ, রামভুটান, লংগান, লটকন, মিয়াজাকি আম, গরুমতি, ভিয়েতনামি মাল্টা, কাটিমন আম, মিসরীয় মাল্টা, রিং মাল্টা, আলুবোখারা, আপেল, নাশপাতি, অ্যাভোকেটরসহ বিভিন্নজাতের ফলের গাছ রয়েছে বাগানটিতে। গত বছর ১ টন মাল্টা বিক্রি করা হয়। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার অধিক হবে বলে তিনি জানান।

তাছাড়া গবেষণা বা পরীক্ষামূলক লাগানো হয়েছে ব্ল্যাক আম্বর ও ঝাড় লেবু। আবহাওয়া ও মাটি উপযোগী হলে ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা হবে এ দুটি ফল।

এদিকে ক্যানসার প্রতিরোধক কেরোসল রোপণ করা হয়েছে এই বাগানে, যা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দামি ফল। এটি আপাতত ফল না দিলেও শিগগিরই এসব গাছ থেকে কেরোসল ফল আশা করা হচ্ছে। এই ফলের জন্য গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল বেশ উপযোগী। এ ফল শীতপ্রধান অঞ্চলে বাঁচতে পারে না। এই ফল ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এটি খেলে ক্যানসার রোগীর কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয় না। এ ফল ক্যানসার সেলের মৃত্যু ঘটাতে কেমোথেরাপির চেয়ে এটি ১০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। তাই এ পাহাড়ে কেরোসল চাষ বেশ সাড়া ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ বছর পুরো বাগানে প্রায় ১৫ লাখ টাকার ফল বিক্রি করা যাবে বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন : উচ্চফলনশীল পাকচোং চাষে খুবির গবেষকদের সাফল্য

শিক্ষিত লোক কৃষি সেক্টরে আসলে কৃষিতে ব্যাপক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হবে জানিয়ে কৃষি উদ্যোক্তা নুর আলম বলেন, আমদানিনির্ভর যেসব ফল রয়েছে সেসব যদি দেশে উৎপাদন করা হয় তাহলে আমদানি নির্ভরতা কমবে পাশাপাশি ডলার সেভ হবে। তাছাড়া আমি চাই যে, হারভেস্ট করার পর যে ফল অন্তত ১৫ থেকে ১ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে সেসব ফল চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ুক। যেন আমরা সহজে বাজারজাত করতে পারি। এতে করে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত কম হবে। তাছাড়া খেজুরটা সম্পূর্ণভাবে আমদানিনির্ভর বিধায় আমদানি নির্ভরতা কমাতে মূলত আমি খেজুর চাষ শুরু করি।

তিনি আরও বলেন, সৌদি খেজুরের চাষাবাদ থেকে ভালো ফল পাওয়ার জন্য কৃষকদের ধৈর্য ধরতে হবে, কারণ খেজুর বাড়তে একটু বেশি সময় লাগে। আর এই খেজুরে পোকামাকড়ের আক্রমণের সম্ভবনাও খুব কম।

খেজুর বাগান দেখতে আসা আমির হোসেন বলেন, পাহাড়ের মাটিতে সৌদির খেজুর চাষ। খবরটি শুনে দেখতে এলাম। দেখে অবাক হলাম, এও কি সম্ভব? পরিবারের জন্য কিছু খেজুর কিনে নিয়ে যাব। বৈচিত্র্যময় সবুজ ও নান্দনিক পাহাড় বেশ সম্ভাবনাময় মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী এখানে সবুজ বিপ্লব সম্ভব।

আরও পড়ুন : কাজুতে স্বপ্ন দেখছেন চাষিরা

মাটিরাঙ্গা উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন বলেন, মাটিরাঙ্গা সৌদি খেজুর চাষের জন্য উপযোগী, কারণ এর জলবায়ু অনেকটা মধ্যপ্রাচ্যের মতো। এ ছাড়া সৌদি জাতের খেজুর কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও বেশি প্রতিরোধী।

সৌদির খেজুর বাংলাদেশে একটি সম্ভাবনাময় ফল মন্তব্য করে মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সবুজ আলী বলেন, খেজুর একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। মাটিরাঙ্গার রসুলপুরে পরীক্ষামূলকভাবে খেজুর চাষ করার বিষয়টি কৃষি বিভাগ অবগত আছে। তার বাগানের অবস্থা বেশ ভালো। কিছু গাছে ফলন এসেছে, পরিপক্বও হয়েছে। তবে এসব চাষে কৃষি বিভাগের সঙ্গে পরামর্শক্রমে চাষ করার কথা বলেন তিনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কেবিন ক্রুদের আসল কাজ কী

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের বড় সুখবর দিল সরকার

জাতীয় দলের কোচিং স্টাফে এবার আইপিএলে কাজ করা অ্যানালিস্ট

আমরা লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে : নেতানিয়াহু

৩ প্যাকেট কাঁচা নুডলস খেয়ে ১৩ বছরের কিশোরের করুণ পরিণতি

তিস্তার বন্যায় কৃষকের স্বপ্ন ভাসছে অনিশ্চয়তার অথৈ জলে

ব্যাংকিং টিপস / ব্যাংকের সুদের হার ও চার্জ সম্পর্কে সচেতন থাকুন

শতভাগ লুটপাটমুক্ত দল জামায়াতে ইসলামী : ড. মোবারক

মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে এসে মারা গেলেন ছেলেও

১০

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১১

সিঙ্গারে চাকরির সুযোগ, দ্রুত আবেদন করুন

১২

মেসিহীন মায়ামিকে বাঁচাল রদ্রিগেজের দুর্দান্ত গোল

১৩

গাজায় যেভাবে দুর্ভিক্ষ নেমে এলো

১৪

লেভান্তের মাঠে বার্সার রোমাঞ্চকর জয়

১৫

যুবদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

১৬

আকিজ গ্রুপে চাকরি, বেতন ছাড়াও থাকবে নানা সুবিধা 

১৭

বাগেরহাটে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল

১৮

যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরি করছে ভারত

১৯

২৪ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

২০
X