পড়াশোনার খরচ চালাতে দীর্ঘ আট বছর ধরে শহরের অলিতে গলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশায় প্যাডেল চেপে নিজের চালায় মনিরুল ইসলাম। পাশাপাশি শ্রমিকের কাজ করেন, এ ছাড়া সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিও করেন তিনি। জীবনের এমন এক বাস্তবতায় গত ১৫ আগস্ট তার ভাড়ায় চালিত রিকশাটি চুরি হয়ে যায়। বর্তমানে তিনি মালিকের রিকশার দাম বাবদ ৪০ হাজার টাকা শোধ করতে পারছে না। চুরি হওয়া রিকশাটি উদ্ধার করার জন্য অসহায় হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
মনিরুল ইসলাম (২৪) যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের (এমএম কলেজ) ভূগোল বিভাগের শিক্ষার্থী ও অনার্স (সম্মান) শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে বর্তমানে ফলপ্রত্যাশী। তিনি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার চাড়াভিটা ষাটখালী গ্রামের মৃত ইউসুফ আলীর ছেলে।
মনিরুল জানান, পড়াশোনার খরচ চালাতে সে দীর্ঘ আট বছর ধরে রিকশা চালায়। খুলনা দারুল কোরআন সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসায় আলিম (এইচএসসি) পড়ার সময় থেকেই তিনি এ কাজ করে পড়াশোনার খরচ চালাতেন। পরে যশোর এমএম কলেজে ভূগোল বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। যশোরে এসেও রিকশা চালিয়ে এবং বিভিন্ন কাজ করে সে পড়াশোনার খরচ চালাত।
মনিরুল বলেন, গত ১৫ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে যশোর প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে এক যাত্রী উঠে চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড মাছ বাজারে যায়। সেখান থেকে আবারও প্রেসক্লাবের পাশের ভবনের সামনে আসে। এখানে এসে বলে ‘আমার পায়ে সমস্যা, দোতলার আখতার ফার্নিচার থেকে হাজি সুমনের চেয়ার এনে দাও।’
মনিরুল জানান, ফার্নিচারের দোকানে গিয়ে জানতে পারি চেয়ারের বিষয়টা ভুয়া। পরে দ্রুত নিচে এসে দেখি রিকশা আর যাত্রী কেউ নেই। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত পুলিশের সহযোগিতায় বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেও রিকশার সন্ধান মেলেনি।
রিকশাচালক শিক্ষার্থী মনিরুল বলেন, আমার এ রিকশাটি ভাড়ার ছিল। মালিক আমার কাছ থেকে ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে সই করে নিয়েছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪০ হাজার টাকা অথবা রিকশার কিনে দিতে হবে। আমার তো সেই সামর্থ্য নেই। আমার বাবা বেঁচে নেই, পরিবার বলতে কিছু নেই।
তিনি বলেন, রিকশা চালিয়ে উপার্জিত অর্থ আমি পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি সেবামূলক কাজে ব্যয় করেছি। আমার কোনো সঞ্চয় নেই। তিনদিন ধরে ঘুমাতে ও খেতে পারছি না। আজ বোনের বাসায় চলে যাচ্ছি। রিকশার মালিককে কীভাবে টাকা শোধ করবো সেই চিন্তা করছি।
তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজপথে থেকেছি, ছাত্রদের আন্দোলনে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছি। এসব কারণে এর আগে আমার ওপর অনেক ঝড় এসেছে। অকারণে আমার রিকশার ব্যাটারি ও চার্জার চুরি হয়ে যেত। অজানা লোক আমার সঙ্গে শত্রুতা করে রিকশার ক্ষতি করতো। এখন তো পুরো রিকশাটায় চুরি হয়ে গেল।
মনিরুলের ভাড়ায় চালিত রিকশা মালিক ওবাইদুর রহমান জানান, রিকশা ভাড়া দেওয়া তো আমার ব্যবসা। এটি তৈরি করতে অন্তত ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। মনিরুল যে রিকশাটি চালাতো সেটি পুরাতন। এজন্য মনিরুলের রিকশার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৪০ হাজার টাকা চেয়েছি। ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করার জন্য আমি তাকে এক সপ্তাহ সময় দিয়েছি।
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের অন্তর্গত কসবা ফাঁড়ির এসআই রিজাউল করিম বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে মনিরুলের চুরি যাওয়া রিকশা উদ্ধার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, প্রায় এক বছর আগে পুলেরহাট মন্ডলগাতি গ্রামে মনিরুলের ওপর হামলা চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। তাকে ছুরিকাঘাত করে সবকিছু ছিনতাই করে নিয়েছিল। তবে লোকজন চলে আসায় রিকশা নিতে পারেনি। সে সময় মনিরুলের নিজের রিকশা ছিল। সেটি বিক্রি করে এবং বিভিন্ন মানুষের আর্থিক সহায়তায় সে চিকিৎসা নিয়েছিল। তাতে তার প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছিল।
মন্তব্য করুন