রেজওয়ান রনি, রংপুর
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ পিএম
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

১ হাজারে দৈনিক সুদ ১০০ টাকা!

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার পূর্ব রমাকান্ত গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম। স্থানীয় সমিতি ও সুদ কারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবাদ শুরু করেন। কিন্তু পরপর দুই বছর লসের মুখে পড়েন তিনি। টাকা শোধ দিতে না পারায় চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে সুদ। দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে শুধু লাভই পরিশোধ করেন এর দ্বিগুণ।

একপর্যায়ে পাওনাদারদের চাপে পরিবার নিয়ে বাড়ি ছাড়েন তিনি। এখন রাজধানীর একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করে সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন।

একই এলাকার আরেক কৃষক দবিয়ার ইসলাম। কয়েকজন মিলে তিস্তার চরে মিষ্টিকুমড়ার চাষ করেন। আবাদের খরচ জোগাতে তিনিও শরণাপন্ন হন সুদ কারবারিদের কাছে। আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে খাটান আবাদের পেছনে। কিন্তু ওইবার আবাদে লস হওয়ায় ঋণের জালে পড়েন তিনি। পাওনাদারদের চাপে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরে টাকা আদায় করতে পাওনাদাররা তার বৃদ্ধ বাবার ওপর চালান শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে আবাদি জমি বন্ধক ও গরু বিক্রি করে তাদের টাকা পরিশোধ করলেও, এখনো অনেক টাকার ঋণ।

শুধু রেজাউল ও দবিয়ার নন, সুদের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে তাদের মতো বাড়িছাড়া হয়েছেন এরশাদ, আব্দুর রাজ্জাক, আইয়ুব আলীসহ এ এলাকার অন্তত ৭০ জন মানুষ। যাদের বেশিরভাগই কৃষক।

কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘সুদ খুব খারাপ জিনিস বাহে। ঋণ নিয়ে আবাদ করছিলাম; কিন্তু আবাদে লস হয়ে যায়। ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে কত টাকা যে পরিশোধ করছি, তার হিসাব নাই। এখনো দেড় লাখ টাকা ঋণ। এটা শোধ করতে করতে সুদসহ ২ লাখ বা তার বেশি দেওয়া লাগবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়া বাড়ি থেকে পালিয়েছি। টাকা পরিশোধ করতে ছোট ছেলে-মেয়েরাও গার্মেন্টসে চাকরি করছে। রোজগার করে টাকা পরিশোধ করে আবার গ্রামে ফিরে আসতে চাই। ঢাকায় আর ভালো লাগে না বলতে বলতেই চোখ বেয়ে পানি নেমে আসে।’

দবিয়ার ইসলাম বলেন, ‘লাভের ওপর টাকা নিয়ে আবাদ করছি, কিন্তু সেই আবাদে লস হইছে। সুদ কারবারিদের চাপে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঘোড়াশালে গেছি। ওরা আমার বাবাকে অপমান করছে, পরে জমি বন্ধক রেখে, গরু বিক্রি করে ওদের আসল টাকা শোধ করলেও এখনো লাভের টাকা পাবে।’

প্রতি বছর দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়ে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন তিস্তা অববাহিকার এই গ্রামের কৃষক। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক কৃষক এলাকার মহাজন ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন। বছরের পর বছর গেলেও তারা ঋণের জাল থেকে বের হতে পারেননি।

স্থানীয় কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সুদের বিনিময়ে ঋণ দেন এ এলাকার কিছু সুদ কারবারি ও নামে-বেনামে গড়ে ওঠা ক্লাব ও সমিতি। ঝামেলা ছাড়া সহজেই ঋণ পাওয়ায় তাদের কাছেই যান মানুষ।

কয়েকজন দাদন গ্রহীতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন মেয়াদ ও লাভে ঋণ দেন সুদের কারবারিরা। মাসিক, সাপ্তাহিক এমনকি দৈনিক ভিত্তিতেও ঋণ দেন তারা। মাসিক হিসাবে ১০ হাজার টাকা নিলে মাসে ১ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহ মেয়াদে নিলে হাজার প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা লাভ দিতে হয়। আর বিশেষ প্রয়োজনে দৈনিক মেয়াদের হিসেবে ১ হাজার টাকায় দিনে ১০০ টাকা সুদ দিতে হয়। এ ছাড়া মৌসুমি ধানের হিসাবে এক লাখ টাকা নিলে বোরো মৌসুমে ২০ মণ ধান ও আমন মৌসুমে ১০ মণ ধান দিতে হয়।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বলেন, ব্যাংক ঋণ নিতে কাগজপত্রের ঝামেলা ও হয়রানির কারণে কৃষকদের আগ্রহ কম। সুদের টাকায় বেশি পরিমাণে লাভ পরিশোধ করতে হলেও কৃষকরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের কাছ থেকে টাকা পান। এ জন্য তাদের দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু নানা কারণে টাকা পরিশোধ না করায় চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বেড়ে যাওয়ায় এ এলাকার অনেক লোক এখন পলাতক।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) রংপুরের উপপরিচালক মো. সহিদুর রহমান সুমন বলেন, আমরা বিভিন্ন এলাকার মানুষদের নানা প্রশিক্ষণের আওতায় আনছি। এ ছাড়া স্বল্প সুদে ঋণ দিয়েও হচ্ছে। কিন্তু আমাদেরও কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে, কোনো সদস্য যদি এক জায়গা থেকে ঋণ সুবিধা নেন, তাহলে আমরা পারতপক্ষে তাদের ঋণ দিই না। কিন্তু একজন মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে যখন সামলাতে পারেন না, তখন বাড়িছাড়া হন।

শুধু রমাকান্ত গ্রাম নয়। সুদের ফাঁদে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন জেলার আট উপজেলার লাখো মানুষ। অনেকে নিজের সবটুকু বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। কেউ পরিবার নিয়ে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছেন। তাদেরই একজন মিঠাপুকুরের বড় হযরতপুর ইউনিয়নের রামরায়ের পাড়া গ্রামের হাবিবুর রহমান। স্থানীয় সন্নাসীর বাজারে চায়ের দোকান চায়ের দোকান চালাতেন তিনি। কয়েক বছর আগে স্থানীয় সমিতি ও সুদখোরের কাছে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সুদের টাকা পরিশোধ করতে করতে নিঃস্ব হয়েছেন। তারপরও টাকা পরিশোধ হয়নি। সমিতি ও সুদখোরের চাপে অবশেষে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকায় চলে গেছেন। সেখানে তিনি গার্মেন্টে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

দুর্গাপুর ইউনিয়নের কাঁঠালি গ্রামের খলিলের ছেলে দেলোয়ার হোসেন কয়েক বছর আগে ৯ লাখ টাকা সুদের ওপর ঋণ নিয়েছেন। সুদের টাকা পরিশোধে তার বাবা ১০ কাঠা জমি দাদন ব্যবসায়ীকে লিখে দেন। তারপরও টাকা শোধ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ঋণের দায়ে ঢাকায় চলে গেছেন।

উপজেলার বৈরাতিহাটের টিন, রড, সিমেন্টসহ কয়েকটি ব্যবসা পরিচালনা করেন ব্যবসায়ী মোয়াজ্জেম হোসেন। স্থানীয় বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন কয়েক বছর ধরে। তার অভিযোগ, ২০২০ সালে ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিলে ভগবতিপুর গ্রামের বেলাল হোসেন নামে একজন দাদন ব্যবসায়ীর কাছে ৬ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। এর বিপরীতে জামানত হিসেবে ফাঁকা চেক প্রদান করেন, যার নম্বর CDA0968803। নিয়মানুযায়ী ওই বছর ব্যাংকের মাধ্যমে ৮ লাখ ও ৩ লাখ করে দুই দফায় ১১ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। তার পরও মোয়াজ্জেম হোসেনের ওই ফাঁকা চেক দিয়ে ৮০ লাখ টাকার ব্যাংক ডিজঅনার মামলা করেছেন দাদন ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন। এ ছাড়া ইটভাটা ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের কাছ থেকেও ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্প নিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ বেলালের বিরুদ্ধে।

তবে অভিযুক্ত বেলালের কাছে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, তার কাছ থেকে টাকা পাইতাম। টাকা না দিয়ে খালি ঘোরায়। ব্যবসায়ী নজরুলের সঙ্গেও এমন ঘটনা হয়েছে জানালে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি বলেন, ইট কেনা বাবদ আমি তাদের কাছ থেকে টাকা পাব।’ এখানকার বাসিন্দা মনজুরুল ইসলাম বলেন, আগে তিন থেকে চার লাখ টাকা হলে ব্যবসায়ীরা ধান ও পাটের ব্যবসা করতেন। এখন যার টাকা হয়েছে, তিনি সুদের ব্যবসা করছেন। বিভিন্ন হাটবাজার ও পাড়া-মহল্লায় ঋণ দেওয়ার নামে অসংখ্য অবৈধ সমিতি গড়ে উঠেছে।

জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. আব্দুস সবুর বলেন, বিভিন্ন নামে-বেনামে সমিতি ও ক্লাব খুলে সুদের কারবার পরিচালনার বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে না সমবায় কর্তৃপক্ষ। আইন সংশোধনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেলে এ ধরনের অভিযোগের তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করার সুযোগ থাকবে।

তিনি আরও বলেন, সমবায়ের নিবন্ধন নিয়ে সুদের কারবার পরিচালনা করেছে, এমন কোনো অভিযোগ আসেনি জেলা সমবায় কার্যালয়ে। জেলা সমবায় দপ্তরের অডিটেও এ ধরনের অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) রাজিয়া সুলতানা বলেন, এ ধরনের অভিযোগ এলে প্রায়োরিটি দিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ বলেন, ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে ক্রমাগত লোকসানের শিকার হয়ে কৃষকরা বাধ্য হয়ে চড়া সুদে মহাজনি ঋণের দ্বারস্থ হচ্ছেন। কৃষকদের জন্য সরকারি উদ্যোগে সহজ শর্তে বিনা সুদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের সারা বছরের কাজ ও খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ জন্য ভিজিডি-ভিজিএফ, টিআর-কাবিখা বিভিন্ন প্রকল্প ব্যাপকভাবে চালু করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে গ্রামীণ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য রেশনিংয়ের আওতা ও পরিমাণ বাড়াতে হবে। তাহলে মানুষকে মহাজনি ঋণের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজীপুরে দিনে ভাঙছে ৩০ সংসার

কে জিতবেন নোবেল শান্তি পুরস্কার

ইরানের সঙ্গে যোগসাজশ / ইরাকের অলিম্পিক কমিটির প্রধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা

বিদায় নিচ্ছে মৌসুমি বায়ু, ১২০ ঘণ্টার পূর্বাভাস দিল আবহাওয়া অফিস

ছাদে টিকটক করার সময় বিদ্যুতায়িত মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু

ভিন্নরূপে শাকিব খান

তামা না পিতল, প্রতিদিনের ব্যবহারে কোন বাসনটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?

‘ট্রাম্প নোবেল না পেলে যে কোনো কিছু করতে পারেন’

শিশু শান্তি ‘নোবেল’ পুরস্কারে মনোনীত সাতক্ষীরার সুদীপ্ত

এই ৪ ভুল করছেন? তাহলে নিজেই ত্বকের ক্ষতি ডেকে আনছেন

১০

শিশুকে হত্যার পর ৭০ ফুট গাছের ওপর ওঠেও রক্ষা পেল না যুবক

১১

মাত্র ১৫০ টাকা খরচ করে ঘরে বসেই সুগন্ধি পারফিউম তৈরি করবেন যেভাবে

১২

ধর্ম অবমাননায় সমান শাস্তির বিধান চায় জাতীয় হিন্দু যুব মহাজোট

১৩

শান্তিতে নোবেল ঘোষণার আগে ওবামাকে নিয়ে ট্রাম্পের ‘বিস্ফোরক’ মন্তব্য

১৪

অতিরিক্ত মাথাব্যথা কি ব্রেন টিউমারের লক্ষণ?

১৫

দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের সম্ভাব্য একাদশ

১৬

সড়কে উঠতে বাধা, ট্রাফিক পুলিশের মাথা ফাটালেন অটোরিকশা চালক

১৭

টানা ৩ দিন ৪ ঘণ্টার কম ঘুমালে কী হতে পারে, জানেন?

১৮

ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের কাছে মাঠে প্রমাণ চাইলেন আনচেলত্তি

১৯

হংকং ম্যাচে হারের পর যা বললেন হামজা

২০
X