প্রদীপ মোহন্ত, বগুড়া
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৭ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে সন্তানের অনন্য প্রয়াস

বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে বহুতল ভবনের দেওয়ালে বিশেষ পদ্ধতিতে আটকে রেখেছে বাইসাইকেল। ছবি : কালবেলা
বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে বহুতল ভবনের দেওয়ালে বিশেষ পদ্ধতিতে আটকে রেখেছে বাইসাইকেল। ছবি : কালবেলা

বাবা একটি শব্দ। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে হাজারো স্মৃতি। এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো মা-বাবা। যাদের বাবা নেই, তারাই বোঝেন বাবা হারানোর ব্যথা। বাবা সাধারণ কেউ নন। ছেলে-মেয়ের কাছে তিনি হলেন সুপারম্যান এবং জীবনের প্রথম হিরো বা এর চেয়েও অসাধারণ কেউ।

কথায় বলে, বাবা-মায়ের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। শারীরিকভাবে চিরকাল তাদের কাছে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে পারেন ছেলে-মেয়েরা। এমনই উদ্যোগ দেখা গেছে বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলার ‘অমরাবতী’ বহুতল ভবনে। সেখানে স্কুলশিক্ষক বাবার ব্যবহৃত জীর্নশীর্ন বাইসাইকেলটি বহুতল ভবনের দেওয়ালে বিশেষ পদ্ধতিতে আটকে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ওই পথে গেলে দেখতে পান দেয়ালে ঝুলানো সেই বাইসাইকেলটি। এটিই ছেলে হিসেবে তার সান্ত্বনা। এই মহৎ উদ্যোগটি নিয়েছেন বগুড়ার স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. তাপস কুমার তালুকদার। প্রথমে তিনি বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হন। তখন তাকে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।

তার বাবার নাম রবীন্দ্রনাথ তালুকদার। তাদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ঘুড়কা ইউনিয়নের ভুইয়াগাঁতি গ্রামে। রবীন্দ্রনাথ তালুকদার চান্দাইকোনা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। রবি স্যার নামেই তিনি এলাকায় পরিচিত ছিলেন। ভুইয়াগাঁতি থেকে চান্দাইকোনা বেশ খানিকটা দূর। আর এ কারণেই তিনি সাইকেলে চেপে নিয়মিত স্কুল করতেন। সেই সাইকেলে চেপেই তিনি তার একমাত্র ছেলে তাপসকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যেতেন। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে বছরের পর বছর তিনি এ সাইকেলটি চালিয়েছেন। রাগবি কোম্পানির সেই সাইকেলে চড়ে তিনি স্কুল করেছেন, প্রাইভেট পড়িয়েছেন ও হাটবাজার করেছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা গ্রামের বাড়িতে তার প্রতিষ্ঠিত দেশি-বিদেশি পুস্তক সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারসহ পুরো বসতবাড়ি ভস্মীভূত করে দেয়। ছোট্ট তাপস ও স্ত্রী-পরিবারসহ তিনি আশ্রয় নেন ভারতের শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু পাঠদান ছিল তার নেশা, সেখানেও শিশু তাপসসহ আশ্রিত শিশুদের জন্য শিবির তত্ত্বাবধায়কের অনুমতি নিয়ে স্থাপন করেন পাঠশালা। শুরু করেন পাঠদান। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধেও তার অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

এরপর একদিন ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাস থেকে নামতে বুকে আঘাত পান। বিধাতা তার প্রাণবায়ু কেড়ে নিলেন। সেদিন ছিল ৫ জুলাই, ১৯৯৬। তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা রেখে গেছেন। বাবার মৃত্যুর পরে তার রেখে যাওয়া স্মৃতিবিজড়িত সাইকেলটি ছেলে ডাক্তার হওয়ার পরও নিয়মিত ব্যবহার করতেন পরম শ্রদ্ধাভরে। ডা. তাপস কুমার তালুকদার ১৯৮৩ সালে বাবার স্কুল (চান্দাইকোনা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এরপর তিনি ১৯৮৫ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এমবিবিএস পাস করার পর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী সার্জন হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্থোপেডিক ও এমএস-অর্থোপেডিক ডিগ্রি অর্জন করেন।

তাপস কুমার তালুকদার ২০২০ সালে বগুড়া শহরের অভিজাত জলেশ্বরীতলা এলাকায় রাস্তার পাশে তিন শতক জমি কিনে নির্মাণ করেন ‘অমরাবতী’ নামের ছয়তলা ভবন। সেই ভবনের উত্তরপাশের দেয়ালে স্থায়ীভাবে আটকে রাখা হয়েছে বাবার সেই স্মৃতিবিজড়িত দ্বিচক্রযান বা বাইসাইকেলটি। ২০২২ সালের ১ জুলাই তিনি সপরিবারে ওঠেন বাড়িটিতে। তার মেয়ে হৃদি অনন্যা ও ছেলে নীলাদ্রি তালুকদার বগুড়ায় অধ্যয়নরত।

বর্তমানে স্মৃতিময় সাইকেলটি তিনি নিজে তো দেখভাল করেনই, তার পাশাপাশি স্ত্রী মনিকা রানী ঘোষও শ্বশুরের সাইকেলটি যত্নআত্তি করেন। বাড়িতে কোনো মেহমান এলেই গল্পসল্প সেরে আপ্যায়নের পর নিয়ে যান সেই সাইকেল দেখাতে। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে দেয়ালে সেঁটে রাখা সাইকেলের ছবি। অসংখ্য মানুষ তাতে কমেন্ট করছেন। বাবার স্মৃতি রক্ষায় এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন ডা. তাপস।

ডা. তাপস কুমার তালুকদার বলেন, বাবার স্মৃতি ধরে রাখতেই এমন উদ্যোগ। কারণ এই সাইকেলে বাবা এবং আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই সাইকেল চালিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাবা স্কুলে গেছেন। আমাকে স্কুলে নিয়ে গেছেন। এ সাইকেলে চড়ে চাকরি করে যে আয় করেছেন, তা দিয়েই আমাদের মানুষ করেছেন। আমাকে ডাক্তার বানিয়েছেন।

চান্দাইকোনা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বাবু মধুসুধন সন্ন্যাসী বলেন, রবীন্দ্রনাথ তালুকদার আমার স্যার ছিলেন, আবার কিছুদিন সহকর্মী হিসেবেও পেয়েছি তাকে। সাদা মনের মানুষ ছিলেন তিনি। অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী মানুষ ছিলেন তিনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যাদের নিয়ে উমামার প্যানেল ঘোষণা

বিয়ের পর স্বাস্থ্য ও ভুঁড়ি বাড়ে কেন? যা বলছেন পুষ্টিবিদ

বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস সিরিজে ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে থাকছেন যারা

ছাগল হত্যার অভিযোগে যুবক কারাগারে

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রকল্পে বিশাল নিয়োগ, ৮ম শ্রেণি পাসেও আবেদন

ড. সরোয়ার ও আসিফ মাহতাবকে হত্যার হুমকি ইস্যুতে হেফাজতের বিবৃতি 

গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের হুমকি, গ্রাহকদের যে বার্তা দিল তিতাস

পাকিস্তানি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেলেন বাংলাদেশি চিকিৎসক

বড় পরিসরে ক্ষেপণাস্ত্রের মহড়া চালাবে ইরান

রহস্যময় ছবির পাশে লেখা ‘আম্মু-আব্বু আমারে মাফ করে দিও’

১০

এবার এনবিআরের ৩ কর্মকর্তাকে বদলি

১১

পানি উঠেছে অমিতাভ বচ্চনের বাংলোতে 

১২

মেসের কক্ষই যেন ‘মিনি সেটেলমেন্ট অফিস’, বিছানার নিচে হাজারো খতিয়ান

১৩

ভারতে নতুন নিয়মে পদ হারাবেন প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী, আসছে বিল

১৪

বিরোধিতার গন্ধ পেলেই মিলবে না মার্কিন ভিসা

১৫

ডাকসু নির্বাচনে বাগছাসের প্যানেল ঘোষণা

১৬

হঠাৎ জ্বর? সেরে উঠতে যা করবেন

১৭

পুরুষ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের কাছে বড় ব্যবধানে হারল নারী লাল দল

১৮

সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বাংলোবাড়ি গুঁড়িয়ে দিল বিআইডব্লিউটিএ

১৯

চার সমুদ্রবন্দরকে সতর্কসংকেত, ঝড়ের আশঙ্কা

২০
X