আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪৪ এএম
অনলাইন সংস্করণ

১০ বছর ধরে বিনামূল্যে সেহরি-ইফতার করাচ্ছেন হোটেল মালিক

রফিক হোটেলে সেহরিতে রোজাদারদের ভিড়। ছবি : কালবেলা
রফিক হোটেলে সেহরিতে রোজাদারদের ভিড়। ছবি : কালবেলা

জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে টানা ১০ বছর ধরে বিনামূল্যে সেহরি-ইফতার খাওয়ান রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম। প্রতিদিন প্রায় তিন শতাধিক রোজাদার ব্যক্তি এখানে সেহরি-ইফতার করেন। বিত্তবান ব্যক্তি না হলেও ১১ মাসে যা আয় করেন সেখান থেকে প্রতিদিন কিছু টাকা সঞ্চয় করে রমজান মাসজুড়ে তিনি ইফতার-সেহরি করান। রমজানের এক মাস মেহমানদারি করান।

রোববার (৯ মার্চ) সেহরির ও ইফতার সময় আক্কেলপুর কলেজ বাজার কাঁচা মালপট্টিতে রফিকের হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, সেহরি ও ইফতার খাওয়ার ভিড় চোখে পড়ার মত। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সবাই হাতে হাতে প্লেট নিয়ে যে যার মত করে টেবিলে বসে ইফতার করছেন। তখন মালিকসহ কর্মচারীও ব্যস্ত সময় পার করছেন। খালি নেই কারও হাত। হোটেলজুড়ে চলে জমজমাট সেহরি-ইফতার পর্ব। টাকা না দিয়ে সেহরি খাবেন সবাই, এটাই রোজার একমাস ধরে রফিক হোটেলের নিয়ম। এই নিয়মটি তিনি প্রায় ১০ বছর থেকে ধরে করে আসছেন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, হোটেলটি তেমন একটা বড় নয়। মালিকও তেমন অবস্থাশালী নয়। তিনি বছরের ১১ মাস হোটেলের খাবার বিক্রি করেন। এই আয় দিয়ে তিনি পুরো বছর সংসার চালান। পাশাপাশি রমজান মাসে সাধারণ মানুষকে টাকা ছাড়াই সেহরি-ইফতার খাওয়ানোর জন্য টাকা জমা করেন। প্রতিদিন সেহরিতে ১৫০ এবং ইফতারে ১৫০ জন রোজাদার ব্যক্তিদের সেহরি-ইফতারি করান।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হোটেল মালিকের নাম রফিকুল ইসলাম রফিক। তিনি ভাড়া নিয়ে হোটেল ব্যবসা করেন। আক্কেলপুর পৌরশহরের কেশবপুর গ্রামে তার বসবাস। তার হোটেলের নামও রফিক হোটেল। তিনি ২০১৬ সাল থেকে রমজান মাসে নিয়মিত টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার করাচ্ছেন রোজাদারকে। দূরদুরান্ত থেকে কলেজ হাটে আসা কৃষক, ট্রেন-বাস যাত্রী, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনরা এই হোটেলে টাকা ছাড়াই নিয়মিত সেহরি ও ইফতারি খাচ্ছেন। হোটেল মালিক রফিকুল নিজে এবং তার হোটেলের কর্মচারীররা মিলে ইফতারি ও সেহরির খাবার পরিবেশন করেন।

সেহরির খাবারে গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ, ভাজি, আলুর ডাল এবং এক গ্লাস দুধ থাকে। আর ইফতারিতে মাংসের বিরিয়ানি, ছোলা বুট, বুন্দা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি, সালাত সাথে একগ্লাস শরবত। রোজাদারেরা তৃপ্তি সহকারে সেহরি ও ইফতার করেন। হোটেলের অভ্যন্তর ছাড়িয়ে বাহিরে হাটের জায়গায় ডেকোরেটরের কাপড় বিছিয়ে ইফতার করানো হয়।

গ্রাম থিয়েটারের নাট্য অভিনেতা মিজানুর রহমান কাজল বলেন, প্রতি বছর রফিক রমজান মাসে ইফতার ও সেহরি খাওয়ায়। এতে গরীব মানুষেরা উপকৃত হয়। এটি একটি মহৎ কাজ। টাকা কম বেশি সবার ঘরেই আছে কিন্তু খাওয়ানোর মন মানসিকতা সবার নেই। ইফতার খেয়ে টাকা দিতে চাইলেও সে কোনো টাকা নেয় না। সকলকে ফ্রিতে ইফতার এবং সেহরি খাওয়ানোই তার ইচ্ছা। রফিক একটা দৃষ্টান্ত, এখান থেকে মানুষকে ও বিত্তবানদের শিক্ষা নিতে হবে। সমাজে যারা অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষ তাদের পাশে দাঁড়ানো। বিত্তশালী ব্যক্তিরা এমন করে এগিয়ে আসলে সমাজ পরিবর্তন হবে।

পার্শ্ববর্তী উপজেলার ক্ষেতলালের দেউগ্রামের বাসিন্দা জাহানারা বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমার ভাগ্নেকে নিয়ে এসেছি। রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য হোটেল খুঁজতে এসে এই হোটেলে আসি। এখানে অনেক ভালো মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। খাওয়ার পরে বিল দিতে এসে জানতে পারি তিনি টাকা না নিয়ে সেহরি খাওয়ান। তার এই কার্যক্রমে আমাদের মতো অনেক বিপদগ্রস্ত লোকের উপকার হয়।

দিনাজপুর জেলার হিলি থেকে আসা এক রোজাদার ব্যক্তি বলেন, আমি রফিক ভাইয়ের বিনা পয়সায় খাওয়ানো ফেসবুকে প্রচার দেখে এসেছি। এখানে এসে ইফতারের সময় হওয়ায় রফিক হোটেলে গিয়ে ইফতার করেছি। আমার কাছে ইফতারির টাকা নেয়নি। আমার মতো অনেকেই ইফতার করেছেন। রফিক ভাই যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা অনেক ভালো একটি কাজ। আল্লাহ পাক যেন তাকে বরকত দেন। তিনি যেন আরও বড় পরিসরে এমন সেবা দিতে পারেন।

ব্যবসায়ী বায়জিতের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, খুব সকালে কাঁচামাল কিনতে বাজারে প্রতিদিন আসতে হয়। প্রতি রমজান মাসে পুরো মাস বিনা পয়সায় সেহরি ও ইফতার করান হোটেল মালিক। বিষয়টি আমার খুব ভাল লেগেছে। তাই আমিও মাল কিনতে এসে এখানে সেহরি খাই।

ইফতার খেতে আসা কমলমতি শিশু আছিব বলেন, আমি এখানে ইফতার খেতে আসছি। ইফতারি খুব ভালো ছিল। ইফতারে বিরিয়ানি, খিরা-টমোটোর সালাতসহ আরও অনেক কিছু।

হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম রফিক কালবেলাকে বলেন, রমজান মাসে খাবারের হোটেলগুলো বন্ধ থাকে। এতে ইফতারি ও সেহরির সময় রোজাদারদের অনেক কষ্ট হয়। বছরের ১১ মাস আমি হোটেল ব্যবসা করে যা আয় হয় তার থেকে প্রতিদিন কিছু টাকা জমিয়ে রেখে রমজান মাসে সকল রোজাদারদের ইফতার ও সেহরি খাওয়ানোর চেষ্টা করি। ২০১৬ সাল থেকে এই কার্যক্রম শুরু করেছি। এ কাজে আমার হোটেলের কর্মচারীরা সহযোগিতা করে। তারাও এই মাসে কোনো পারিশ্রমিক নেয় না। মূলত পরকালের মুক্তি এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই আমি এই কাজ করি। আমি যতদিন বাঁচবো এটা যেন চালু রাখতে পারি এজন্য আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা করবেন।

আক্কেলপুর কলেজ বাজার বণিক সমিতির সভাপতি কাজী শফি উদ্দীন বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে দেখছি কলেজ বাজার রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম তার হোটেলে বিনে পয়সায় সেহরি ও ইফতার করিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে আক্কেলপুর হাসপাতালে, রেলস্টেশনে ও কাঁচাবাজারে বাহির এলাকা থেকে আগত রোজাদাররা অনেক উপকৃত হন। আক্কেলপুরে অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি রয়েছে তবে আমার কলেজ বাজারে থাকা ৫০ বছরে এমন চিত্র নজরে পড়েনি। এটি একটি মহৎ কাজ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউনেস্কোর ৪৩তম সাধারণ সম্মেলনের সভাপতি বাংলাদেশ

ভারতীয়দের জন্য সংকুচিত হচ্ছে মার্কিন দরজা

‘সোলজার’র প্রথম ঝলকে কী বার্তা দিলেন শাকিব খান?

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ / ক্যানসার আক্রান্ত সেই রাশিদার চিকিৎসার দায়িত্ব নিল খুলনা মেডিকেল

টিকিট কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে ডিসি সারোয়ারের হুঁশিয়ারি

আবরার ফাহাদ স্মরণে ৮ স্তম্ভ নির্মাণ, ব্যয় কত

মুক্তি পেলেন ইসরায়েলে আটক পাকিস্তানের জামায়াত নেতা

মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্টে হজযাত্রী নিবন্ধনের বিষয়ে যা জানা গেল

তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতৃত্ব দেবেন : এম এ মালিক

এক দিনের ব্যবধানে আরও বাড়ল স্বর্ণের দাম

১০

বাংলাদেশ সফরের জন্য আইরিশদের দল ঘোষণা

১১

এবার আরেক অপ্রতিরোধ্য সক্ষমতা অর্জনের পথে পাকিস্তান

১২

কুমিল্লায় গৃহবধূকে ধর্ষণ, ২ যুবক গ্রেপ্তার

১৩

মেঘনায় অভিযানিক দল ও জেলেদের সংঘর্ষ

১৪

হংকংয়ের বিপক্ষে জয় নিয়ে আশাবাদী হামজা

১৫

যে ৬ সমস্যায় কখনোই এআইয়ের পরামর্শ নেওয়া যাবে না

১৬

গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা

১৭

চাঁদাবাজদের উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে : কফিল উদ্দিন

১৮

ডাকসুর জিএস ফরহাদ হোসেনকে রাঙামাটিতে সংবর্ধনা

১৯

পুলিশ সদস্যদের হামলা ও অপদস্তের প্রতিবাদ দুই সংগঠনের 

২০
X