ধনবাড়ী (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৩, ০৫:৩৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বারের আক্ষেপ

‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশটা স্বাধীন করেছি, অথচ আজ নিজেই পরাধীন’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার জোয়াদ্দার। ছবি : কালবেলা
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার জোয়াদ্দার। ছবি : কালবেলা

শিকলে বাঁধা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার জোয়াদ্দারের জীবন। পায়ে পরা শিকল আর তালায় বন্দি জীবন তার। বড় ছেলে লাভলু জোয়াদ্দারের আধা পাকা ঘরে দিন রাত বন্দি থাকেন তিনি। রাত হলে দরজার বাইরে আরও একটি তালা ঝুলে। খাওয়ার কষ্ট আর বিনা চিকিৎসায় খুব কষ্টে আছেন রণাঙ্গনের এই যোদ্ধা।

সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত এই হতভাগা বীর মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার পাইস্কা ইউনিয়নের ভাতকুড়া গ্রামের মৃত জামাল উদ্দিন জোয়াদ্দারের ছেলে। ০১১৮০৮০০৬৩ মুক্তি বার্তা নম্বর আর ৬০১৭ গেজেট নম্বরের বীর মুক্তিযোদ্ধা জব্বার এক সময়কার সম্পদশালী সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। কিন্তু জীবনচক্রে এখন অসহায় পরাধীন তিনি।

আব্দুল জব্বার ১৯৭১ সালে ঢাকার আশরাফ জুট মিলে মেকানিক সেকশনে মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। যুদ্ধ শুরু হলে বাড়িতে না জানিয়ে তিনি কারখানা থেকে সরাসরি পালিয়ে মেসের চৌকি, বিছানাপত্র মাত্র ৩২ টাকায় বিক্রি করে ভারতে গিয়ে নগেন্দ্র বাবুর কাছে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ১১ নম্বর সেক্টরে আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তিনি।

স্থানীয়রা জনান, স্বাধীনতার ৫ বছরের মাথায় এলাকায় ঘটে আলোচিত (নগর সরকার পরিবার) হত্যাকাণ্ড। সে ঘটনায় তিনি দুই নম্বর আসামি হিসেবে জেলে যান। টানা ১৩ বছর জেল খাটেন। আদালতে দোষ প্রমাণে ফাঁসির আদেশ হয়। এরশাদের শাসনামলে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতার আওতায় প্রাণভিক্ষার আবেদনে ক্ষমা পেয়ে জেল থেকে মুক্ত হন। এই মামলায় অনেক সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান তিনি। প্রথম স্ত্রী বেঁচে থাকলেও দ্বিতীয় স্ত্রী বেঁচে নেই। দুপক্ষের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে জব্বারের। জেলে যাওয়ার পর পৈতৃক সম্পত্তি স্থানীয় প্রভাশালীদের দ্বারা বেহাত হয়ে যায়। অনেক কষ্টে কিছু জমি উদ্ধার হয়েছে। সেখানেই তিন ছেলে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করেছেন। বড় ছেলে লাভলুর ঘরেই তার বন্দি জীবন কাটে।

জানা গেছে, তিন ভাই মিলে প্রভাবশালীদের বিশেষ সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধা বাবার ভাতা গ্রহণ করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। ৮ লাখ টাকা লোন তোলা হয়েছে। সেটিও তিন ভাগ হয়েছে।

দ্বিতীয় ছেলে বাবলু জোয়াদ্দার স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি জানান, তাদের পক্ষের তিন ভাই এক বোন। বড় লুৎফর রহমান লাভলু, দ্বিতীয় বাবলু জোয়াদ্দার, ছোট নুরন্নবী ওরফে নুরুল ইসলাম, বোন স্বপ্না। অপর পক্ষের বোন জীবন আক্তার।

বাবলু আরও জানান, তার বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। মুক্ত থাকলে যে কোনো ধরনের অঘটন ঘটানোর আশঙ্কায় তাকে শিকলে বেঁধে রাখা হয়।

বাবলুর স্ত্রী জানান, তার যত্নআত্তির কোনো অভাব হয় না। আজও মুরগির মাংস ও ঢেঁড়শ ভর্তা দিয়ে ভাত দেওয়া হয়েছে।

শিকলে বাঁধা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার জোয়াদার জানান, কেন আমাকে এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে, তা আমি নিজেও জানি না। ’৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করেছি। অথচ আজ আমি নিজেই পরাধীন হয়ে গেছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার ছেলেরাই তাকে দীর্ঘদিন যাবৎ এভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। তিনি মুক্ত জীবনেরও আঁকুতিও জানান।

রণাঙ্গনের এই যোদ্ধা আরও জানান, তার ব্রেনের সমস্যা ছিল। এখন সুস্থ, অযথা তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। বিদায়ের সময় তিনি এ প্রতিবেদককে দুপুরের আহারের আহ্বানও জানান।

সরকারি ভাতার বিষয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ভাতার বইয়ের পুরো পাতায় ছেলেরা স্বাক্ষর নিয়ে রেখেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে কখনো তার খোঁজ নেওয়া হয়নি।

ধনবাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন কালু বীর মুক্তিযোদ্ধা জব্বার জোয়াদ্দার শিকলে বন্দি থাকার কথা সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, মানসিক বিকারগ্রস্ত। মুক্ত থাকলে অঘটন ঘটাতে পারেন। তাই ছেলেরা তাকে এ অবস্থায় রেখেছেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসলাম হোসাইন জানান, ঘটনাটি জানতে পেরে আমি উপজেলা বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) হাবিবুর রহমান সুমনকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। পরিদর্শনকালে ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য নির্ধারিত বীর নিবাসে থাকার ব্যবস্থা এবং তার সরকারি ভাতার টাকা তিনি ছাড়া অন্য কেউ যেন উঠাতে না পারে এজন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘ভুয়া তথ্য’ রুখতে জাতিসংঘের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর সেই বিধবা পেলেন সহায়তা

যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী ভিসায় সময়সীমা আরোপের উদ্যোগ

তাসকিন-তানজিমে বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা, কলম্বোতে শুরুতেই টাইগারদের দাপট

মুদি দোকানে মিলল টিসিবির ১৪৪২ লিটার তেল 

বিমানে যাত্রীদের সঙ্গে উঠে গেল সাপ, অতঃপর...

সংসদ নির্বাচনে ৪৮ লাখ ডলার দিচ্ছে জাপান

১২ কেজি এলপিজির দাম কমলো 

সরকারি অফিসে ৫০ ভাগ লোক কাজ করে না : আসিফ নজরুল

গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শ্রমিক দল-ছাত্রদলের ৩ নেতা বহিষ্কার

১০

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতায় বিপিসির উদ্বেগ 

১১

ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে ‘মুক্তির পাঠাগার’ স্থাপন করল ছাত্রদল নেতা

১২

চলে গেলেন জীনাত রেহানা

১৩

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে যুক্তরাষ্ট্রে দোয়া মাহফিল 

১৪

পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরানের বড় ঘোষণা

১৫

ডিম বাছাইকে কেন্দ্র করে দোকানিকে ছুরিকাঘাত

১৬

কাজাখস্তানে প্রকাশ্যে মুখ ঢেকে রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা

১৭

তেজগাঁও থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রিয়াল উদ্ধার, আটক ৬

১৮

মাইক্রোবাস-ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত ২

১৯

আরেক আ.লীগ নেতার কারাদণ্ড

২০
X