‘পরশুদিন ঘর-দুয়ার ঝাড়িল রে। মোর ঘর দুয়ার পরিষ্কার করি মোক ছাড়ি চলি গেল রে। একপালা কাপড়চোপড় ধুয়ে দিছে। আল্লাহ রে! মোর সন্তানকে এমন করি নিয়ে গেলু কেন।’ ঠিক এভাবে বিলাপ করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা আলো বেগম। তাকে সান্ত্বনা দিতে আসা কেউই সন্তানহারা মাকে মাটি থেকে তুলতে পারছিলেন না। বাবা আনারুল ইসলামও নির্বাক। মেয়েকে হারিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না তিনি।
মঙ্গলবার (১৩ মে) সকাল পৌনে নয়টার দিকে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের বেইলি ব্রিজ এগ্রিকালচার অ্যান্ড পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের পাশে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে একই পরিবারের ৩ জন নিহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন- রুবি (৩৬), আফসানা আকতার সিনহা (১৬) ও রাহাত (২)। আহত হন আশরাফুল ইসলাম। তারা সবাই একই পরিবারের সদস্য। আফসানা মীরবাগ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এবারের অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় কাউনিয়া মোফাজ্জল হোসেন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছিল সে।
আহাজারি করতে করতে মা আলো বেগম বলেন, ‘হামার মেয়ে কোটে গেল। মোর বেটিক আনি দেও। আইজ শেষ পরীক্ষা আছিল। মোর কলিজাক আল্লাহ তুলি নিল কেন।’
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে অসুস্থ শিশু সন্তানকে ডাক্তার দেখাতে স্ত্রীসহ কাউনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যাচ্ছিলেন আশারফুল ইসলাম। এ সময় এসএসসি পরীক্ষার্থী ভাতিজির পরীক্ষা কেন্দ্র পাশেই হওয়ায় তাকে মোটরসাইকেলে তুলে নেন চাচা আশরাফুল। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে রংপুর কুড়িগ্রাম মহাসড়কের বেইলি ব্রিজ এগ্রিকালচার এন্ড পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের পাশে রাস্তায় আকস্মিকভাবে একটি মাইক্রোবাস ব্রেক করে। এ সময় বাসটির পিছনে আরেকটি থ্রি হুইলার মাহিন্দ্রা ব্রেক করে। একই সময়ে মোটরসাইকেল ব্রেক করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার বামদিকে পড়ে যান আশরাফুল। আর ডানদিকে রাস্তার উপর স্ত্রী, ভাতিজি ও ছেলে পড়ে যায়। এ সময় পিছন দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগামী বাস তাদের চাপা দিয়ে গেলে ঘটনাস্থলে মারা যায় তিনজন।
দুর্ঘটনাস্থলের পাশে ভুট্টাক্ষেতে কাজ করছিলেন কৃষক আলম মিয়া। তিনি কালবেলাকে বলেন, দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেখানে ছুটে গিয়ে দেখেন আহত মোটরসাইকেলচালক লাশগুলোকে টেনে রাস্তার পাশে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে তিনি যাওয়ার আগেই বাসটি চলে যায়।
সরেজমিনে মঙ্গলবার দুপুরে উত্তর মহেশা গ্রামে নিহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো গ্রামজুড়ে আর্তনাদ আর আহাজারি। বাড়ির উঠানে রাখা হয়েছে তিনটি মরদেহ ও খাটিয়া। মরদেহের পাশে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন আর প্রতিবেশীরা।
এদিকে কাউনিয়া থানা পুলিশ নিহতদের মরদেহ নিতে তাদের বাসায় এলে পরিবার ও স্থানীয়রা বাধা দেন। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সুরতহাল করতে চিকিৎসক সেখানে আসেন। আগামীকাল বুধবার (১৪ মে) সকালে মীরবাগ বাজারে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছেন স্থানীয়রা।
কাউনিয়া থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহানুর আলম বলেন, পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার পথে ঘটনাস্থলে আশরাফুল ইসলামের মোটরসাইকেলের সামনে একটি মাইক্রোবাস ছিল। তখন তিনি মোটরসাইকেল ব্রেক করলে তারা ছিটকে পড়ে। পরে একটি বাস তাদের পেছনদিক দিয়ে চাপা দিয়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যায়। তারা ঘাতক বাসটি আটক করার চেষ্টা করছেন। এ ঘটনায় সড়ক আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন