হোয়াংহুকে চীনের দুঃখ বলা হয়, তেমনি জামালপুরের সরিষাবাড়ীবাসীর দুঃখ হচ্ছে ৩টি আন্তঃনগর ট্রেন। সাধারণত যাত্রাপথে নিরাপদ বাহন হিসেবে বেশিরভাগ মানুষ ট্রেনকেই বেছে নেয়। চাহিদার তুলনায় আসনসংখ্যা কম হলেও সবাই চেষ্টা করে ট্রেনে যাতায়াতের।
তবে জামালপুর জেলাশহর এবং সরিষাবাড়ী উপজেলার সাধারণ মানুষের বড় দুঃখের কারণ হয়ে উঠেছে এ তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন। সরিষাবাড়ীতে যাতায়াতকারী জামালপুর এক্সপ্রেস, অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ও যমুনা এক্সপ্রেস আন্তঃনগর এ ৩টি ট্রেনের বাজে টাইমিং, ঘনঘন বিরতি এবং নিম্নমানের লোকোমোটিভ ব্যবহারের কারণে ট্রেনের যাত্রীদের দুর্ভোগের সীমা নেই। এ ছাড়া যমুনা এক্সপ্রেস ও অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসের আসনগুলোও নিম্নমানের এবং বেশিরভাগ কোচ পুরাতন। এ যেন দেখার কেউ নেই। ফলে দুর্ভোগ নিয়েই যাত্রীরা নীরবে চলাচল করছে এ ৩টি ট্রেনে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, কেবল জামালপুর জেলাতেই ঢাকা হতে ৫টি আন্তঃনগর এবং দুটি মেইল ট্রেন চলাচল করে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর মধ্যে দুটির গন্তব্যস্থল ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ বাজার, ঢাকা-তারাকান্দি দুটি এবং ঢাকা-ভূয়াপুর একটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, নির্দিষ্ট টাইম শিডিউলে অন্যান্য ট্রেনগুলো চললেও আন্তঃনগর জামালপুর এক্সপ্রেস এবং আগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেনের বেলায় চলে আসে বিপত্তি। ট্রেন দুটি ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে সকাল সকাল ছাড়লেও সবচাইতে বেশি বিড়ম্বনা তৈরি হয় ঢাকায় পৌঁছাতে। ট্রেন দুটি ঢাকা হতে ছাড়ার পর দেড়-দুই ঘণ্টা দেরিতে প্রায় নিয়মিত জামালপুরের স্টেশনগুলোতে পৌঁছাচ্ছে।
আবার ফিরতি ঢাকার পথেও সময়ের বিড়ম্বনায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছায় ঠিক মাঝরাতে। এতে ফিরতি পথে ট্রেন দুটিতে সবসময়ই যাত্রীশূণ্যতা তৈরি হচ্ছে ।
এ ট্রেন দুটিতে যারা যাত্রী হচ্ছে তারা মাঝরাতে রাজধানী শহরে প্রবেশ করছে। এতে একদিকে যেমন নিজেদের বাসায় পৌঁছাতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে অন্যদিকে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়।
যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ট্রেন দুটির শিডিউল পরিবর্তন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এভাবে যাত্রীশূণ্য ট্রেন দুটি ঢাকার পথে নিয়মিত চললে জামালপুর অঞ্চলের যাত্রীদের তেমন কোনো সুবিধা তৈরি হবে না। এতে রেলওয়ে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব হতেও বঞ্চিত হচ্ছে।
যদি কার্যকর শিডিউল ব্যবস্থায় ট্রেন দুটিকে ফেরানো সম্ভব হয় তাহলে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলের তিন উপজেলার মানুষের রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক যোগাযোগ আরও বেশি সহজ হবে। রেলওয়েও তার নির্দিষ্ট রাজস্ব হতেও বঞ্চিত হবে না।
সরেজমিনে গিয়ে সরিষাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনে ঢাকাগামী যাত্রী ইসমাইলের সঙ্গে কথা বললে তিনি কালবেলাকে জানান, জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী অঞ্চল বৃটিশ আমল থেকেই রেলপথের সঙ্গে যুক্ত। ২০১২ সালে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হতে যমুনাসেতু পূর্ব পর্যন্ত নতুন লিংক রোড এবং ২০২০ সালে জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেন চালু ছাড়া রেলওয়ের এ অঞ্চলে দৃশ্যমান উন্নয়ন আর চোখে পড়েনি।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে আন্তঃনগর ৩টি ট্রেনেরই নিয়মিত শিডিউল বিপর্যয় যাত্রীদের ট্রেন বিমুখ করে তুলেছে। এ অঞ্চলের ট্রেন দুটির যাত্রীবান্ধব করতে কার্যকর শিডিউল থাকা দরকার। বিশেষ করে জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে পুরাতন রুটে (ঢাকা-টাঙ্গাইল-জামালপুর) ফিরিয়ে দেওয়া এবং এর শিডিউলটি পরিবর্তন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো নজরই দিচ্ছে না।
ঢাকাগামী যাত্রী সুফিয়া আক্তার জানান, ট্রেন নিরাপদ বাহন হলেও আমাদের অঞ্চলের যাত্রীদের জন্য বিশাল এক দুর্ভোগের কারণ। জামালপুর এক্সপ্রেস ও অগ্নীবিণা এক্সপ্রেস সঠিক সময়ে সরিষাবাড়ী স্টেশন ছেড়ে যেতে দশ বিশ মিনিট দেরি হলেও ঢাকায় কখন পৌঁছে সেটা ধারণা করা কঠিন বলে জানান তিনি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিহাব হোসেন বলেন, গতবছর জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকায় গেলে ট্রেনটি রাত ২টায় কমলাপুর স্টেশনে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে তেজগাঁওয়ে নিজের মেসে যাওয়ার পথে মগবাজারে ছিনতাইয়ের শিকার হই। বড় ক্ষতি না হলেও সেসময় মোবাইল, নগদ অর্থ এবং হাতঘড়ি খোয়া যায় ।
যদি সময়োপযোগী শিডিউলে ব্যবস্থা করা যায় তবে ট্রেন দুটির যাত্রীরা অনেক বেশি উপকার পাবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি নজর দেওয়া উচিত বলে জানান শিহাব।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, সরিষাবাড়ী হতে ২০১২ সালে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চালু হওয়া তারাকান্দি-ভূঁয়াপুর-যমুনা সেতু লিংক রেলপথ ছিল জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ এ ৫ জেলার মানুষের স্বপ্ন। যমুনা সেতু পূর্ব থেকে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের সরাসরি রেল যোগাযোগ উন্নয়নের জন্য এই রেলপথ তৈরি হলেও বাস্তবিক অর্থে সঠিক শিডিউল এবং ব্যবস্হাপনার অভাবে এ স্বপ্ন যেন অধরাই রয়ে গেছে।
জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার তারাকান্দি থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার লিংক রেলপথ। বর্তমানে টাঙ্গাইলের যমুনা সেতু পূর্ব রেলস্টেশন থেকে ভূঞাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এতে করে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ ছাড়াও পণ্য পরিবহনেও পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি।
এদিকে ময়মনসিংহ-জামালপুর-টাঙ্গাইল রেলপথে চলাচলকারী গরিবের ট্রেন নামে খ্যাত ধলেশ্বরী এক্সপ্রেস মেইল (৭৫-৭৬) এক বছর ধরে বন্ধ। ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা জামালপুর-টাঙ্গাইলে চলাচলকারী ধলেশ্বরী এক্সপ্রেস মেইল ট্রেনটি ইঞ্জিন সংকটের অজুহাতে গত বছরের ২৮ মে থেকে বন্ধ রয়েছে। ফলে ময়মনসিংহ হতে সরিষাবাড়ী-তারাকান্দি-ভুয়াপুর রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার যাত্রী।
ধলেশ্বরী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ময়মনসিংহ থেকে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে ময়মনসিংহের বিদ্যাগঞ্জ, পিয়ারপুর, জামালপুর জেলার নরুন্দি, নান্দিনা, জামালপুর টাউন রেলওয়ে স্টেশন, কেন্দুয়া বাজার, জাফরশাহী (ভাটারা), সরিষাবাড়ী, তারাকান্দি, জগন্নাথগঞ্জ পুরাতন ঘাট, শহীদনগর এবং টাঙ্গাইল জেলার হেমনগর, ভূঞাপুর ও ইব্রাহিমাবাদ (পূর্বের নাম যমুনা সেতু পূর্ব) রেলওয়ে স্টেশনে চলাচল করত। এসব রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের ট্রেনের ভাড়ার থেকে ২/৩ গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বাধ্য হয়ে অন্য যানবাহনে করে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। সব থেকে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সরিষাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার আসাদুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন মোটামুটি সঠিক সময়ে সরিষাবাড়ী স্টেশন ছেড়ে গেলেও ঢাকায় পৌঁছাতে দেরি হয়। এটাকে সরাসরি শিডিউল বিপর্যয় বলা যাবে না তবে বেশ দেরি করে ঢাকায় পৌঁছে জামালপুর এক্সপ্রেস ও অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস। এ ছাড়া যমুনা এক্সপ্রেসও বিলম্ব করে তবে ওই দুই ট্রেন একটু বেশি দেরিতে ঢাকায় পৌঁছে।
তিনি বলেন, ট্রেনগুলোর শিডিউল পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। স্টেশনগুলোতে লোকবল বৃদ্ধি এবং আধুনিকায়ন করে যাত্রী সেবা উন্নত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়ার বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন