কুষ্টিয়ার শিল্পপতি এস এম কামরুজ্জামান নাসির অগ্রণী ব্যাংকের তিন কর্মকর্তার যোগসাজশে ১৩ কোটি টাকার এলসি জালিয়াতি ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেছেন। এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন ব্যাংকের কুষ্টিয়া অঞ্চলের ডিজিএম সাবিনা সুলতানা, বড়বাজার শাখার ব্যবস্থাপক এজিএম এনামুল হক এবং বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তা তানভীর।
বিষয়টি জানাজানি হলে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করে এবং একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে, অগ্রণী ব্যাংক প্রধান শাখার বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ থেকে কুষ্টিয়া বড়বাজার শাখার এজিএমকে চিঠি দিয়ে তিন দিনের মধ্যে ৯ লাখ ৭১ হাজার ৩৭০ দশমিক ৫৮ ডলার সমপরিমাণ টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বড়বাজার শাখার কর্মকর্তারা।
ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, এলসি সুবিধা পেতে হলে গ্রাহককে শতভাগ মার্জিন জমা দিতে হয় এবং সিআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই জালিয়াতিতে কোনো কিছুই মানা হয়নি। গ্রাহক ছিলেন ঋণখেলাপি, সেটি গোপন রেখে তাকে অবৈধ সুবিধা দেওয়া হয়। ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা একযোগে নিয়ম লঙ্ঘন করে সাড়ে ১২ কোটি টাকার এলসি অনুমোদন করেন।
সূত্র জানায়, সাবিনা সুলতানা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় দায়িত্ব পালনকালে একই ব্যক্তির নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়মবহির্ভূত ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ডিজিএম সাবিনা সুলতানা জানান, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানে। তাদের অনুমতি ছাড়া তিনি কিছু বলবেন না।
ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ১৯টি এলসি খোলা হয়। এর মাধ্যমে ১২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৫৭ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১২ কোটি ৫৯ লাখ ২৩ হাজার ৮৩২ টাকা বিদেশে পাঠানো হয়। এই অর্থের বিপরীতে কোনো জামানত রাখা হয়নি এবং তা এখনো ব্যাংকে ফেরত আসেনি।
সূত্র জানায়, এসব এলসির ক্ষেত্রে প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি ছাড়াই সুইফট মেসেজ পাঠিয়ে বিল পরিশোধ করা হয়, যা নিয়মবহির্ভূত। এই অনুমতি ছাড়া অর্থ প্রেরণে ডিজিএম সাবিনা সুলতানা এবং এজিএম এনামুল হক জড়িত ছিলেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এজিএম এনামুল হক দাবি করেন, এলসি সুবিধা নিয়ম মেনেই দেওয়া হয়েছিল এবং তখন কামরুজ্জামান কোনো ব্যাংকের খেলাপি ছিলেন না।
গত ১৫ মে তানভীরকে কুষ্টিয়া পৌরবাজার শাখায় বদলি করা হয়। নতুন কর্মকর্তা যোগ দিয়ে দেখতে পান, কেএনবি এগ্রো ফিডের নামে নিয়মবহির্ভূত এলসি খোলা হয়েছে। তিনি তাৎক্ষণিক বিষয়টি এজিএম ও ডিজিএমকে জানান। তারা বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন; কিন্তু কোনো সমাধান না হওয়ায় তিনি খুলনা বিভাগীয় জেনারেল ম্যানেজারকে অবহিত করেন। এরপর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এক কর্মকর্তা জানান, তানভীর এর আগেও দুটি শাখায় ঋণ জালিয়াতিতে অভিযুক্ত ছিলেন। তার নামে অডিট আপত্তি রয়েছে, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তিনি অফিসার (ক্যাশ) পদে থাকলেও তাকে বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কামরুজ্জামান নাসির সিটি ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখা ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক দিলকুশা শাখাতে ঋণখেলাপি। আল আরাফাহ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কেএনবি এগ্রো ফিডের নামে ২৩০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়, যার পরিশোধিত সুদসহ মোট পরিমাণ ২৩৫ কোটির বেশি। এই ঋণের বিষয়ে অর্থঋণ আদালতে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। সিটি ব্যাংক সূত্র জানায়, কেএনবি ফিড ও কেএনবি ফ্লাওয়ার মিলস—দুই প্রতিষ্ঠানই তাদের শাখায় ঋণখেলাপি। এদের মালিক কামরুজ্জামান নাসির।
অগ্রণী ব্যাংকের খুলনা বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার সামছুল আলম বলেন, আমরা বিষয়টি জানি এবং তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। শিগগির তা জমা দেওয়া হবে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেএনবি এগ্রো ফিড লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার জাহিদুল ইসলাম জানান, এলসি বা ঋণের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না, এসব দেখাশোনা করেন প্রতিষ্ঠানের মালিক। কামরুজ্জামান নাসিরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বরং বারবার কেটে দেন।
মন্তব্য করুন