‘নদীর হারে বাপ-মা বিয়া দিছে। হানির লগে যুদ্ধ করি ত্রিশ বছর কাডাই দিছি, অন আর কই যামু। বিয়ার বছর ঘত হানি উঠছিল, হেদিনর কষ্টের কথাও অন ভুলিন। বিয়ার দিনতুন অইতে আজ্জা হর্যন্ত গাঙ্গের হানির লগে যুদ্ধ করি বাঁচি রইছি। আন্ডান্তে টেয়া থাইকলে বেঙ্গিন বেচি উঁচা জাগাত ঘর বাইন্তাম।’
কথাগুলো বলছিলেন ৬০ বছর বয়সী ফেনীর পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের মুহুরী নদীর ভাঙনে বসতভিটাসহ ঘরবাড়ি হারানো পারুল আক্তার। ১৯৯৫ সালে পারুল আক্তারের সঙ্গে চিথলিয়া ইউনিয়নের আলতাব আলী চৌধুরীর বিয়ে হয়। তাদের ঘরে দুই ছেলে সন্তান রয়েছে।
১৫ বছর আগে ২০১০ সালে তার স্বামী আলতাব আলী চৌধুরী মারা যান। বড় ছেলে মাসুম তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন। আর ছোট ছেলে মাহফুজ চতুর্থ শ্রেণিতে। তারপর থেকে পারুল আক্তার দুই সন্তানকে নিয়ে মুহুরী নদীর ভাঙা-গড়ার খেলায় লড়াই করে বেঁচে আছেন।
পারুল আক্তারের জীবনযুদ্ধ যেন থামছেই না। নিত্যনতুন নিষ্ঠুরতাই তার জীবনের গল্পে লেখা হচ্ছে। পারুল আক্তার জানান, চলতি মাসের ৮ জুলাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সন্ধ্যার পর ঘরে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি, মুহুরী নদীর মাধ্যমে ভারত থেকে নেমে আসা উজানের পানি লোকালয়ে ঢোকে। তার বসতঘরের পেছন দিয়ে মুহুরী নদীর ৮০ মিটার দীর্ঘ একটি বাঁধ ভেঙে মুহূর্তে পারুল আক্তারের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। ভেজা কাপড়ে বের হয়ে পাশের একটি বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেন। এক সপ্তাহ পর বন্যার পানি নেমে গেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু নিষ্ঠুর নির্মমতা, সোমবার (২১ জুলাই) রাতের বৃষ্টিতে নদীর পানি বেড়ে যায়। ভাঙন স্থান দিয়ে পানি ঢুকে আবারও তার বসতঘরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দুপুরে সরেজমিন পারুল আক্তারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে কোথাও পানি, কোথাও হাঁটু পরিমাণ কাদা জমে আছে। ঘরের ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। ঘরের মাঝখান দিয়ে পানির স্রোতে অনেক বড় ড্রেন হয়ে গেছে। আসবাবসহ জিনিসপত্র সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
পারুল আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এই ঘরে বসবাস করার আর কোনো সুযোগ নেই। মেরামত করতে যে টাকা খরচ হবে, সেটাও আমার নেই। যেহেতু বাঁধ এখনো মেরামত হয়নি, তাই যে কোনো সময় আবারও পানি ঢুকতে পারে। এজন্য বিত্তবানসহ সমাজের লোকজনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন।
পারুল আক্তারের বড় ছেলে মাসুম চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। ছোট ছেলে মাহফুজ গ্রামের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এলাকায় বিভিন্ন স্থানে মধু সংগ্রহ করে বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করেন। তাদের দুই ভাইয়ের ঘরও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
মাসুম আর মাহফুজ স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিকটআত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু মা পারুল আক্তার বসতবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসপত্র দেখছেন।
টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ৮ জুলাই থেকে ফেনীতে বন্যা দেখা দেয়। ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। প্লাবিত হয় জেলার পাঁচ উপজেলার ১৩৭টি গ্রাম। গত বছরের আগস্টের ভয়াবহ বন্যায় রেশ কাটতে না কাটতেই পরশুরাম উপজেলার মুহুরী নদীর ১৫টি স্থানে বাঁধ ভেঙে যায়।
পানিতে উপজেলার ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এবারের বন্যায় ফেনীতে প্রায় ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, গ্রামীণ সড়ক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবকাঠামো মিলিয়ে এ ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।
মন্তব্য করুন