সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন স্পট থেকে প্রকাশ্যে পাথর লুটপাট ও পাচারের ঘটনা ঝড় তোলার পর থেকেই টনক নড়েছে প্রশাসনের। তদন্ত কমিটি গঠন থেকে শুরু করে একের পর অভিযান পরিচালনা করে পাথর উদ্ধার ও প্রতিস্থাপন, মামলা-গ্রেপ্তার ও জরিমানা করা হচ্ছে নিয়মিত।
একইসঙ্গে জড়িত থাকা ও পেশাগত দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে বদলি করা হচ্ছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) সকালে জৈন্তাপুরের শ্রীপুরে অভিযান চালিয়ে আনুমানিক ২০ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করেছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত টাস্কফোর্স। উদ্বার সে পাথরগুলো রাংপানিতে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আর রাংপানির নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিজিবির হাতে। এ সময় জব্দ প্রায় ২৮ হাজার ঘনফুট বালু উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করা হয়।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জর্জ মিত্র চাকমার নেতৃত্বে অভিযানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের এসিল্যান্ড, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা।
প্রশাসন বলছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ড এলাকা থেকে চোরাকারবারিরা এসব পাথর ও বালু নিয়ে আসে। এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক মামলা করবে পুলিশ। একইসঙ্গে সীমান্তে চোরাচালান রোধে বিজিবিকে কঠোর নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এর আগে সোমবার (১৮ আগস্ট) পরিচালিত টাস্কফোর্সের অভিযানে বাংলাবাজার সংলগ্ন নদীর তীর থেকে প্রায় ৩৫ ট্রাক বালু জব্দ করা হয়। পরে উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে জব্দ বালু ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া একটি স্থানীয় ক্রাশার মেশিন থেকে প্রায় ৯ হাজার ৫০০ ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়, যা রাংপানি নদী থেকে উত্তোলিত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। জব্দ এসব পাথর বিষয়ে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ক্রাশার মালিকের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করা হয়। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন জৈন্তাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) ফারজানা আক্তার লাবনী।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) সকালে ভোলাগঞ্জ এলাকার সাদাপাথর ছাড়াও সীমান্তবর্তী পর্যটনকেন্দ্র উৎমাছড়া ও রাংপানিতে লুটের পাথর উদ্ধারে প্রশাসনিক অভিযানের পাশাপাশি অভিযানে নেমেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির নজরদারিতে উৎমাছড়ায় দুই লাখ ঘনফুট লুটের পাথরের সন্ধান মিলেছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানা বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়ন। বিজিবি জানায়, উৎমাছড়া এলাকা প্রাকৃতিকভাবে বালু ও পাথরে সমৃদ্ধ এবং পর্যটন এলাকা হিসেবে সুপরিচিত। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় কিছু অসাধু চক্র উৎমাছড়া থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে আদর্শপাড়া গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পাচারের উদ্দেশ্যে মজুত করে আসছে।
তবে সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজিবির কঠোর নজরদারি, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় অসাধু চক্রের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে তারা মজুত করা পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করতে ব্যর্থ হয়।
মঙ্গলবার সকালে ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক কর্নেল মো. নাজমুল হকের নেতৃত্বে উৎমাচছড়ার আদর্শগ্রামে বিশেষ অভিযান চালায় একটি টহল দল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এলাকায় প্রায় দুই লাখ ঘনফুট পাথর মজুত রয়েছে।
পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইফ্রাহিম ইকবাল চৌধুরীর নেতৃত্বে স্থানীয় প্রশাসন, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথবাহিনীর অভিযানের মাধ্যমে উদ্ধার করা পাথরের সঠিক পরিমাপ ও আইনি ব্যবস্থার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
গত সোমবার (১৮ আগস্ট) বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জৈন্তাপুরের শ্রীপুর পাথর মহালের রাংপানি বিজিবির নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) সেখানে দিনভর অভিযান চালিয়ে আনুমানিক ২০ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করেছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত টাস্কফোর্স। উদ্বার করা পাথর প্রতিস্থাপন করা হয়েছে রাংপানিতে।
রাংপানির নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রশাসনিকভাবে বিজিবির হাতে দেওয়া হয়েছে। এর আগে জব্দ করা প্রায় ২৮ হাজার ঘনফুট বালু উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করা হয়। একইসঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে, সিলেটের কানাইঘাট লোভাছড়া পাথর কোয়ারির সব ধরনের পাথর স্থানান্তর ও পরিবহন বন্ধ করেছেন হাইকোর্ট বিভাগ। মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানি না হওয়া পর্যন্ত এ আদেশ বহাল থাকবে।
কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার এ তথ্য জানান। তিনি জানান, বাংলাদেশ খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো তাকে এক চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি অবহিত করেছে।
এর আগে ২০২০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর লোভাছড়া পাথর কোয়ারি থেকে ১ কোটি ৪ লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করে। পরবর্তীতে আইনি জটিলতা নিষ্পত্তি হলে ওই জব্দ পাথরের মধ্যে ৪৪ লাখ ঘনফুট খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো নিলামের মাধ্যমে ‘পিয়াস এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। নিলামকৃত পাথর পরিবহনের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ৪৫ দিন সময় দেওয়া হয়।
পরে আরও এক মাস সময় বাড়ানো হয়। তখন ওই লিজের নামে হাইকোর্টে চলমান মামলায় জব্দ ৬১ লাখ ঘনফুট পাথর লুট করে নেয় লিজগ্রহীতার লোকজন। সব পাথর পরিবহন শেষ হওয়ায় আর সময় বাড়ায়নি বিএমডি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পিয়াস এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও সিলেট মহানগর ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান চৌধুরী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
শুনানি শেষে মঙ্গলবার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট লোভাছড়া পাথর কোয়ারির সব ধরনের পাথর স্থানান্তর ও পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
বিএমডির সহকারী পরিচালক এজাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, মঙ্গলবার লোভাছড়া পাথর কোয়ারি এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে পিয়াস এন্টারপ্রাইজের লোকজনকেও এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়েছেন। এখন কেউ এ আদেশ অমান্য করলে স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
সিলেটের ভোলাগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে অবাধে পাথর চুরি ও পাচারের অভিযোগে দায়িত্বে অবহেলা করার কারণে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন নাহারকে বদলি করে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
কিন্তু মঙ্গলবার সকালে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. খান রেজা-উন-নবীর এক আদেশে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পরিবর্তে চুনারুঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিন মিয়াকে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
মন্তব্য করুন