রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় নুরাল পাগলার আস্তানায় আগুন দেওয়ার পাশাপাশি ভাঙচুর চালিয়েছে উত্তেজিত জনতা। এ সময় কবর থেকে নুরাল পাগলার লাশ উঠিয়ে মহাসড়কে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তুমুল এ সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ১০-১২ জন পুলিশসহ দুই পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে।
শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) জুমার নামাজের পর এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার দুপুর থেকেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কাজ করে সেনাবাহিনী, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কিন্তু এ ঘটনা কেন ঘটলো, এ প্রশ্ন এখন জনমনে। স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধর্মীয় অনুশাসন বিকৃত করা ও নিজেকে ইমাম মেহেদী দাবি করার অভিযোগে নুরাল পাগলের প্রতি ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষোভ ছিল।
বিশেষ করে, গত ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান নুরাল পাগলা। ওইদিন রাতে মাটি থেকে ১২ ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় আস্তানায় তার লাশ দাফন করেন ভক্তরা। পবিত্র কাবাঘরের আদলে তৈরি করা হয় কবর। এসব কর্মকাণ্ডকে ‘শরিয়ত পরিপন্থি’ দাবি করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়গুলো নিয়ে স্থানীয় আলেম সমাজ এবং বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ডাক দেওয়া হয়েছিল। বৃহস্পতিবারের (৪ সেপ্টেম্বর) মধ্যে কবর নিচু না করলে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিক্ষোভে নামার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছিল।
এরপর থেকেই উত্তেজনা চলছিল জেলাজুড়ে, ফুঁসে ওঠে স্থানীয় আলেমসহ স্থানীয় জনতা। তারা কবর সমতল করাসহ কয়েকটি দাবি জানায়।
গত ২৫ আগস্ট জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বিক্ষুব্ধ জনতা এবং নুরাল পাগলার পরিবারের সদস্য ও ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনায় কোনো সুরাহা হয়নি। ওই দিন তৌহিদি জনতা ও নুরাল পাগলার পরিবারের সদস্য ও ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা করেন গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদুর রহমান। তাতেও কোনো সমাধান হয়নি। পরে বিক্ষোভের চাপে পড়ে কবরের রং পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় নুরাল পাগলার পরিবারের সদস্যরা।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবারে অনৈতিক কার্যকলাপ হয়, এমন অভিযোগ তোলে উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। কয়েক ফুট উঁচুতে কবর শরিয়ত পরিপন্থি দাবি করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে বিক্ষোভের ঘোষণা দেন সংগঠনটির নেতারা।
এ সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির সভাপতি মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক। সংবাদ সম্মেলনে নুরুল হকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় রীতিনীতি বিকৃত ও কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে তার আস্তানায় ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ করা হয়।
পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর (বুধবার) একই দাবিতে রাজবাড়ী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। লিখিত বক্তব্যে জেলা ইমাম কমিটির সভাপতি ইলিয়াস মোল্লা বলেন, গত ২৩ আগস্ট নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলা মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে গোয়ালন্দ পৌর সভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জুড়ান মোল্লার পাড়া এলাকায় মাটি থেকে ১২ ফুট উঁচুতে বেদি তৈরি করে দাফন করা হয় এবং পবিত্র কাবার আদলে রং করা হয়েছে ওই বেদির, যা শরিয়তবিরোধী। এতে ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। প্রশাসনের আশ্বাসে বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সময় নেয় ওই কবর ১২ ফুট থেকে নামিয়ে স্বাভাবিক কবরের মতো করা হবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
লিখিত বক্তব্যে ইলিয়াস মোল্লা আরও বলেন, আগামীকালের মধ্যে কবর স্বাভাবিক না হলে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে। এরপরে শুক্রবার কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলায় বিক্ষোভ হবে। তারপরের শুক্রবার ঢাকা থেকে সারা দেশব্যাপী ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর রাজবাড়ী জেলা আমির মো. নুরুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাজবাড়ী শাখার সেক্রেটারি আরিফুল ইসলাম প্রমুখ।
তারই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) জুমার নামাজের পর স্থানীয় মুসল্লিরা একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন এবং গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে একটি সমাবেশও করেন।
এরপর, তারা নুরাল পাগলার আস্তানায় হামলা চালিয়ে কবর ও অন্যান্য স্থাপনা ভাঙচুর এবং আগুন ধরিয়ে দেন। কবর থেকে নুরাল পাগলের লাশ উঠিয়ে মহাসড়কে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এর আগে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার দিকে গোয়ালন্দ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন নুরাল পাগলের পরিবার ও ভক্তরা। সংবাদ সম্মেলনে গোয়ালন্দ পাক দরবার শরিফকে নিয়ে অপ্রচার করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে ভক্ত মেহেদি আল আমিন বলেন, আলেম ওলামাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় নুরাল পাগলার কবর উঁচু থেকে নিচু করা হয়েছে, কবরের দেয়ালের রং পরিবর্তন ও ‘ইমাম মেহেদি দরবার শরিফ’ লেখা সাইনবোর্ড অপসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এখানে মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছাড়া এখানে খ্রিষ্টান ধর্মের কেউ আসে না।
পরে এদিন দুপুর ১২টার দিকে গোয়ালন্দ পাক দরবার শরিফ পরিদর্শন করেন জেলা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসনসহ জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির নুরুল ইসলাম।
পরিদর্শন শেষে জেলা জামায়াত নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, দাবির মধ্যে কবর নিচু করা হয়েছে। তবে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজকের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে এবং মূল দাবি মেনে নেওয়ায় আগামী শুক্রবারের মার্চ ফর গোয়ালন্দসহ অন্যান্য কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় দুপুরে জুমার পর বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। হঠাৎ নুরাল পাগলার আস্তানায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা।
মাটি থেকে ১২ ফুট উুঁচুতে এবং কাবা শরিফের আদলে কবর তৈরি করা নিয়ে কয়েক দিন ধরেই ফুঁসে উঠেছিল উত্তেজিত জনতা। তারই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার হামলা চালানো হয় নুরাল পাগলার আস্তানায়। পাল্টা আক্রমণ করেন নুরাল পাগলের ভক্তরা। তুমুল সংঘর্ষে দুই পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হন। পরে নুরাল পাগলার আস্তানায় ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। এ সময় কবর থেকে নুরাল পাগলার লাশ উঠিয়ে মহাসড়কে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে হামলা চালানো হয় পুলিশের ওপর, ভাঙচুর করা হয় পুলিশের গাড়ি।
শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাত ১২টার পর গোয়ালন্দ ঘাট থানার এসআই সেলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাত সাড়ে ৩ হাজার জনকে আসামি করে মামলা করেন। পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এ মামলা করা হয়েছে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি রাকিবুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দরবার শরীফে সাধারণ মানুষের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে নুরাল পাগলার দরবার শরীফ এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। নুরাল পাগলার দরবারে হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি।
মন্তব্য করুন