দুর্গাপূজা মানেই দেবীর আরাধনা, ঢাক-ঢোলের তালে আনন্দ আর ভক্তির আবহ। তবে এবারের পূজায় রাজশাহী শহরের মালোপাড়ার শ্রীশ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ দেব বিগ্রহ ঠাকুর মন্দির তাদের ক্ষুদ্র আয়োজনের মধ্যেই এনেছে বিশাল এক বার্তা। স্বল্প বাজেট ও আকারে ছোট হলেও প্যান্ডেলটি যেন রূপ নিয়েছে নারীশক্তি ও সমাজ সচেতনতার এক প্রতীকী মঞ্চে।
এবারের থিম ঘিরে ধরা হয়েছে নারীর জীবনসংগ্রাম, সম্মান ও নিরাপত্তার আখ্যান। কন্যা ভ্রূণের নীরব আর্তি থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনের পথচলা, অবিবাহিত অবস্থায় সামাজিক চাপ, সংসারের লড়াই, আর বার্ধক্যে অবহেলা—সবকিছু একে একে ফুটে উঠেছে প্যান্ডেলের দেয়াল আর সাজসজ্জায়।
প্রথম অংশে চোখে পড়ে কন্যা ভ্রূণের অস্তিত্বের ক্ষতচিহ্ন, যা দর্শনার্থীদের ভাবনায় আঘাত হানে। অন্য অংশে উঠে এসেছে ইভটিজিংয়ের ভয়াবহতা, চার দেয়ালের ঘরে বন্দি নারীর নিঃসঙ্গতা এবং সমাজের বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। পাশাপাশি দেখা যায় সংগ্রামী নারীর দৃঢ় প্রত্যয়—যা সমাজকে পরিবর্তনের বার্তা দেয়।
দেবীমূর্তির সাজও এ বছর ভিন্ন মাত্রা এনেছে। যেখানে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর শান্ত সৌন্দর্যের ছাপ স্পষ্ট, সেখানে চণ্ডীর শক্তিময় রূপ যেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। বিশেষভাবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের পুরাণিক দৃশ্যটি তুলে ধরা হয়েছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেবী শক্তির আবির্ভাবের বার্তা হিসেবে।
প্যান্ডেলের শেষ প্রান্তে বৃদ্ধাশ্রমের প্রতীকী দৃশ্য দর্শকদের মন নাড়িয়ে দিয়েছে। দেয়ালে লেখা—‘১০ মাস ১০ দিন যন্ত্রণার ফল কি? আজ বৃদ্ধাশ্রম!’, ‘এক মাকে পুজো করো, আর এক মাকে ঘর থেকে বের করো?’ এই লাইনগুলো যেন সমাজের কঠোর বাস্তবতার আয়না।
দেয়ালজুড়ে লেখা কবিতা ও স্লোগানগুলো দর্শনার্থীদের আবেগে ভাসিয়েছে। যেমন—‘আসতে দাও পৃথিবীতে, করছো কেন খুন? আমার দোষ কি শুধু আমি কন্যা ভ্রূণ?’ অথবা—‘ফিনফিনে কাপড়ের ভাঁজে, খুঁজে ফেরো নারী। কখনো মানুষ ভেবে সুযোগ দিও! দেখবে, আমরাও পারি।’
সবশেষে বড় অক্ষরে লেখা এক পঙ্ক্তি যেন দর্শকদের হৃদয়ে বাজিয়ে দিয়েছে তীব্র বার্তা—‘সুনিশ্চিত হোক নারীর নিরাপত্তা, থেমে না যাক তাদের স্বপ্নযাত্রা।’
মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুনন্দন দাস বলেন, ‘আমরা চাই, দেবীর পূজার আনন্দের পাশাপাশি মানুষ নারীর অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে ভাবুক।’
সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী পাপন চন্দ্র রায় বলেন, ‘দুর্গোৎসব শুধু আনন্দ নয়, এটি সচেতনতারও মঞ্চ। আমাদের উদ্দেশ্য প্রতিবাদ নয়; বরং নারীর সংগ্রামী জীবনকে উৎসবের আবহে ফুটিয়ে তোলা।’
কোষাধ্যক্ষ রতন পাল আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এই থিম নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে নতুন ভাবনার জন্ম দেবে। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের স্ফুরণ ঘটাতে পারলেই আমাদের প্রয়াস সফল হবে।’
দর্শনার্থীরাও বলছেন, আয়োজকরা প্রমাণ করেছেন—পূজা শুধু আনন্দের উৎসব নয়, বরং সামাজিক সচেতনতারও শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। আকারে ছোট হলেও এই প্যান্ডেল যে বিশাল এক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে, সেটাই এবারের রাজশাহীর দুর্গোৎসবের সবচেয়ে আলোচিত দিক।
মন্তব্য করুন