মশিউর রহমান, জামালপুর
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪৭ পিএম
আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৩৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

নদীভাঙনে বদলে যাচ্ছে জামালপুরের মানচিত্র!

স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন। পুরোনো ছবি
স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন। পুরোনো ছবি

দেশ ভাগের জন্য বা আন্তঃপ্রশাসনিক কারণে কোনো অঞ্চলের মানচিত্র পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু একটা জেলার মানচিত্র পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে শুধু নদীভাঙনে! নদীমাতৃক বাংলাদেশে যে কয়টি জেলা সারা বছর ভাঙনের মুখে থাকে তার মধ্যে জামালপুর একটি।

জামালপুরে বর্ষার ভরা মৌসুমে কিংবা শীতের শুকনো মৌসুমেও যমুনা নদীর পাড় ভাঙতে দেখা যায়। এ ছাড়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্রেও ভাঙনে বদলে যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ভরা নদীতে ভাঙন দেখা দিচ্ছে জিঞ্জিরাম নদীতে। ঝিনাই নদীর বেশিরভাগ অংশ ভরাট হয়ে গেছে, আগের মতো নেই। তাই ভাঙনও দেখা যায় না।

যমুনার করালগ্রাস আর ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনেই বদলে গেছে জেলার মূল মানচিত্র। শুধু ভাঙনেই থেমে নেই নদীগুলো, শুকনো মৌসুমে জেগে ওঠা চর নিয়ে তৈরি হয় ঝগড়া। মারামারি, কাটাকাটিও হয় কখনো কখনো।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ‘সেচ, পানি উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়’ -এর যাত্রা শুরু হয়, ১৯৯৪ সালে ‘পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়’ হিসেবে নতুনভাবে এর নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে সারাদেশে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে থাকে। জামালপুরেও পাউবোর কার্যক্রম আছে। স্বাধীনতার পর থেকেই নদীভাঙনের শিকার জামালপুরের মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পায়নি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

জানা গেছে, ইমার্জেন্সি ডাম্পিং, এনডিআরসহ বিভিন্ন প্রকল্পে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও স্থায়ী বাঁধ তৈরির প্রকল্প সহজে পাস হয় না। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ভাঙতে ভাঙতে, লাল ফাইলের দৌরাত্ম্য চলতে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বসতভিটা ভাঙার পর হয়ত একটা সময় গিয়ে একটা প্রকল্প পাস হয়।

দেওয়ানগঞ্জের পোল্লাকান্দি এলাকার স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক মিকা কালবেলাকে বলেন, আমি জন্মের পর যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই দেখি প্রায়ই নদীভাঙন। এ পর্যন্ত অসংখ্যবার আমাদের বাড়িঘর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যাদের একটু জায়গাজমি বেশি আছে তারা ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয় কিন্তু যাদের শুধু বাড়ির জায়গাটুকু নদীগর্ভে হারিয়ে যায়, তাদের সপরিবারে অন্য কোথাও চলে যেতে হয়। বেশিরভাগই চলে যায় ঢাকায়। রাজধানীতে গিয়ে তারা জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার চেষ্টা করে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য হাসমত আলী কালবেলাকে বলেন, আমাদের বাড়িঘর ২৫-২৬ বার পরিবর্তন করতে হয়েছে। আগেও নদীভাঙন ছিল, এ বছরও পাশের গ্রামে নদীভাঙন চলছে।

জামালপুর জেলার উত্তর পশ্চিম, পশ্চিম এবং পশ্চিম দক্ষিণ অংশে পুরো যমুনা নদীতে ঘেরা। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ এবং সরিষাবাড়ী উপজেলা যমুনার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বদলে গেছে জামালপুর জেলার মূল মানচিত্র। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে হাজার হাজার একর আবাদি জমি, বাজারঘাট, সরকারি বেসরকারি অসংখ্য স্থাপনা নিমেষেই তলিয়ে গেছে যমুনার করালগ্রাসে। ২০৩২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের জামালপুর জেলায় বর্তমানে পঁচিশ লাখ মানুষের বসবাস।

মাদারগঞ্জের পাকরুল এলাকার আব্দুল হক (৭০) বলেন, পাশে জামথল এলাকায় যমুনা নদীতে বাঁধ তৈরি করেছে কিন্তু কয়েক বছর ধরে টানা ভাঙনের মুখে পড়েছে এই এলাকা, প্রতিবছর জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয় কিন্তু স্থায়ী বাঁধ না দেওয়ায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ এবং সরিষাবাড়ীর যমুনা তীরবর্তী এলাকার মানুষ এবং স্থানীয় সচেতন একাধিক নাগরিকদের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার।

দেওয়ানগঞ্জের এক স্কুল শিক্ষক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এ বছর দেওয়ানগঞ্জ এবং বকশীগঞ্জের নদীভাঙন নিয়ে স্থানীয়রা একাধিক মানববন্ধন করেছে যাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের একটাই দাবি তারা নদীভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ চান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যমুনার ভাঙন রোধে প্রায় আটাশ কিলোমিটার এবং ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন রোধে দশ কিলোমিটারের মতো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ২৪-২৫ অর্থ বছরে ডাম্পিং, এনডিআরসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৯৪ কোটি টাকা। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে।

জামালপুর নাগরিক ভয়েসের সভাপতি সাংবাদিক কাফি পারভেজ কালবেলাকে বলেন, নদীভাঙন জামালপুর জেলার নিত্যদিনের সঙ্গী। বর্ষা মৌসুমে শুধু নয়, শুকনো মৌসুমেও নদীভাঙনের শিকার জামালপুর। সরকার আসে সরকার যায়, এমপি মন্ত্রী এসে দেখে যায় কিন্তু প্রতিবছর কিছু মানুষের বসতভিটা হারাতে হয়। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে ছুটতে হয় রাজধানীর বুকে। স্বাধীনতার পর থেকে নদীভাঙনের ক্ষতির হিসাব করলে দেখা যেত কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নকিবুজ্জামান খান কালবেলাকে বলেন, আমরা আমাদের কাজ করছি। কোনো এলাকায় নদীভাঙনের খবর পেলে দ্রুত সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রকল্প অনুমোদনের জন্য যা যা করার করে থাকি কিন্তু পাশ করার দায়িত্ব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের।

ইসলামপুরের পচাবহলা বাজার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ভাঙন চলছে, সেখানে একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে পাশ হচ্ছে না বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, যমুনা নদীতে বিশ কিলোমিটার এবং ব্রহ্মপুত্রে দশ কিলোমিটারের মতো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হলে হয়ত নদীভাঙন মোটামুটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে তিন হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হতে পারে বলে জানান তিনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কেন শুধু জাতীয় দলের হয়েই খেলতে চাইলেন রোনালদো?

যে শহরে দিনে ২ ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ!

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে লালুর বক্তব্য ব্যক্তিগত : বিএনপি

নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া শাপলার ৭ নমুনা প্রকাশ এনসিপির

লন্ডনে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়রের সঙ্গে বাসস চেয়ারম্যানের মতবিনিময় 

ডিআরইউ বর্ষসেরা রিপোর্টের জন্য পুরস্কার দেবে নগদ

হৃদয়-মিরাজে ভর করে বাংলাদেশের লড়াই

শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

ওমানে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ বাংলাদেশি নিহত

১০ বছরে পাঠাও, রয়েছে মাসজুড়ে অফার

১০

রাকসু নির্বাচন / জিএস প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মারের ‘ভোট চাইছেন’ শেখ হাসিনা!

১১

এখন পরনির্ভর হয়ে আছি, আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা

১২

দুদকের মামলায় সাবেক এমপি বদির বিরুদ্ধে আরও দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণ

১৩

শহিদুল আলমদের বহরের সব নৌযান আটক, কোথায় নেওয়া হচ্ছে?

১৪

বানরের আক্রমণে শতাধিক ছাত্রী আহত

১৫

মুখ খুললেন রাশমিকা মান্দানা

১৬

গুমের শিকার বিশেষ বন্দিদের ‘মোনালিসা’ নামে ডাকা হতো

১৭

রাজশাহীতে হাজার ছাড়িয়েছে সাপে কাটা রোগী, মৃত্যু ৩৮

১৮

মানসিক স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করে যে ১০ খাবার

১৯

চট্টগ্রামের সিকো অ্যারেনাতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পাবেন রবি এলিট গ্রাহকরা

২০
X