

‘আমার ছোট ছোট দুই মেয়ে...তাদের নিয়ে আমি এখন কোথায় যাব? কী খাওয়াব, কীভাবে বড় করব? আমি এখন কার কাছে যাব?’ এই কথাগুলো বলতে বলতে বুক চাপড়াচ্ছিলেন নিহত নাজমুল হোসেনের স্ত্রী শারমিন বেগম। কথা আটকে যাচ্ছিল কান্নায়। পাশে দুই শিশু কন্যা— জান্নাতি (৩) আর জামেলা (২) কিছুই বুঝতে না পেরে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে আছে।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) সকালে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চর নিচ খানপুর গ্রামে নাজমুলের বাড়িতে গেলে এমন করুণ দৃশ্য চোখে পড়ে।
উঠোনজুড়ে মানুষের ভিড়, আহাজারি আর নীরবতা। শারমিনের বুকফাটা কান্না যেন থামছে না। বারবার বলতে থাকেন, ‘ওরা আমার স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলল...আমি এখন কী করব?’
এর আগে, গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) দৌলতপুরের পদ্মার চরে খড়ের মাঠ দখল নিয়ে কুখ্যাত কাকন বাহিনী ও মণ্ডল বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন নাজমুল। একই ঘটনায় মারা যান আমান মণ্ডলসহ আরও দুজন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে দুজনের মরদেহ যখন গ্রামে ফিরে আসে, তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে পুরো গ্রাম। জানাজার সময় শিশু দুই মেয়ে জান্নাতি আর জামেলা মায়ের কোলে বসে নির্বাক চেয়েছিল— যেন বুঝতেই পারছিল না, কেন সবাই কাঁদছে।
নিহতের পরিবারের সদস্যদের দাবি, চরাঞ্চলের জমির দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কথিত ‘কাকন বাহিনী’ এ হামলা চালিয়েছে।
নাজমুলের বাড়ির পাশের মুদির দোকানে বসে ঘটনার সময়কার স্মৃতি মনে করছিলেন স্থানীয় মিঠু সরদার। তিনি বলেন, ‘বেলা ১১টার দিকে দেখি দুইটা স্পিডবোটে কাকন বাহিনীর লোকজন আসে। কোনো কথা না বলে গুলি শুরু করে দেয়। আমরা গুলির ভয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। ওদের হাতে বড় বড় বন্দুক। তিনজনকে চিনেছি— চাকলাইয়ের ময়না, সাগর আর ফিলিপনগরের বুরবক। দুই ঘণ্টা ধরে গুলি চলছিল। মোবাইল বের করতে পারিনি, শুধু প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম।’
কাঁপা কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সাধারণ কৃষক। মাঠ দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের কোনো অস্ত্র নাই। খড় কাটতেই গিয়েছিলাম। এখন মাঠও গেল, মানুষও গেল।’
স্থানীয় চরের বাসিন্দারা জানান, প্রায় ১৭ বছর আগে হবির চরের নিচ খানপুর এলাকায় ৩০-৩৫টি পরিবার বসবাস করত। নদী ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে তারা বাঘার চর নিচ খানপুরে আশ্রয় নেন। তাদের দাবি, পুরোনো চরে প্রায় ৯০০ থেকে ১ হাজার বিঘা জমি তাদের পূর্বপুরুষদের দখলে ছিল। সেই জমিতে চাষাবাদ করতেন তারা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কাকন বাহিনীর দাপটে তারা সেখানে ফসল তুলতেও পারছিলেন না।
জানা গেছে, গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) সকালে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাবেন শুনে তারা পদ্মার চরে যান। কিন্তু সেখানে গিয়েই মুখোমুখি হন গুলিবর্ষণের। সেই গুলিতেই প্রাণ যায় নাজমুল ও আমানের। পরের দিন মঙ্গলবার লিটন আলী নামের আরও একজনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌবাহিনীর সদস্যরা।
ডা. নিহার চন্দ্র মণ্ডল বলেন, মুনতাজের শরীরে অন্তত শতাধিক, রাকিবের শরীরে প্রায় ৮০, নাজমুলের শরীরে ৩৫টির মতো এবং আমানের মাথাসহ শরীরের পাঁচ স্থানে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো পিস্তল ও রাবার বুলেট হতে পারে।
এ বিষয়ে বাঘা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুপ্রভাত মণ্ডল বলেন, নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। আহতদের বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন