

রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়ার পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে দাপিয়ে বেড়ানো সন্ত্রাসী চক্রগুলোর বিরুদ্ধে অবশেষে ব্যাপক সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’।
রোববার (৯ নভেম্বর) ভোর থেকে দিনব্যাপী চলে এই অভিযান। এতে অংশ নেয় পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা।
অভিযানে মোট ১১টি সন্ত্রাসী বাহিনীর ৬৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের অধিকাংশই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ইঞ্জিনিয়ার হাসিনুজ্জামান কাকনের নেতৃত্বাধীন ‘কাকন বাহিনী’র সদস্য। এ সময় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, মাদকদ্রব্য, মোটরসাইকেল, নৌযান ও বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানায়, সম্প্রতি পদ্মা চরের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, রাজশাহীর বাঘা ও নাটোরের লালপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মরিচা ইউনিয়নের চৌদ্দহাজার মৌজার নিচ খানপাড়া এলাকায় ভয়াবহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। গত ২৭ অক্টোবরের ওই সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে কাকন বাহিনীর প্রধান হাসিনুজ্জামান কাকনসহ তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে দৌলতপুর থানায় মামলা করা হয়। এরপর থেকেই সন্ত্রাসীদের দমন ও চরাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যৌথ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ প্রশাসন।
রোববার ভোরে রাজশাহীর বাঘা, পাবনার আমিনপুর ও ঈশ্বরদী এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে একযোগে অভিযান শুরু হয়। এতে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, র্যাব ও এপিবিএনের প্রায় ১ হাজার ২০০ সদস্য অংশ নেন। পদ্মার দুর্গম চরাঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতে পুলিশকে নৌপথে যেতে হয় এবং চরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ঘিরে ফেলা হয় সন্ত্রাসীদের আস্তানা। দিনভর অভিযান চালিয়ে ৬৭ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজশাহী রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহান রোববার বিকেলে তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযানের বিস্তারিত তথ্য জানান। তিনি বলেন, রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর জেলার চরাঞ্চল থেকে ৫৮ এবং খুলনা রেঞ্জের কুষ্টিয়ার দৌলতপুর এলাকা থেকে আরও ৯ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা কাকন বাহিনীসহ ১১টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য। গ্রেপ্তারদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই একাধিক হত্যা ও অস্ত্র মামলায় সাজা রয়েছে।
ডিআইজি আরও জানান, অভিযানে রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা জেলা থেকে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র, চার রাউন্ড গুলি, দুটি গুলির খোসা, ২৪টি হাসুয়া, ছয়টি ডোসার, দুটি ছোরা, চারটি চাকু, তিনটি রামদা, দুটি চাইনিজ কুড়াল, একটি লোহার পাইপ, একটি টিউবওয়েল, পাঁচটি মোটরসাইকেল, ২০ বোতল ফেনসিডিল, ৮০০ গ্রাম গাঁজা ও ৫০ পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের চরাঞ্চল থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা, একটি স্পিডবোট, অস্ত্র রাখার জন্য ব্যবহৃত একটি সিলিন্ডার, দুটি তাঁবু ও পাঁচটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে।
পদ্মার চরে দীর্ঘদিন ধরে একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যক্রমে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছিল। পুলিশের তথ্যমতে, কাকন বাহিনীর পাশাপাশি আরও ১০টি সক্রিয় বাহিনী রয়েছে— মণ্ডল বাহিনী, টুকু বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, লালচাঁদ বাহিনী, রাখি বাহিনী, শরীফ কাইগি বাহিনী, রাজ্জাক বাহিনী, চল্লিশ বাহিনী, বাহান্ন বাহিনী, সুখচাঁদ ও নাহারুল বাহিনী। এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্রপাচার, চর দখল, জেলে ও কৃষকদের হয়রানি এবং সর্বহারা সংগঠনকে আশ্রয় দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ।
ডিআইজি শাহজাহান জানান, অপারেশন ফার্স্ট লাইটই শেষ নয়, বরং এটাই শুরু। চরাঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত অভিযান চলবে। সন্ত্রাসী বাহিনীর কার্যক্রম পুরোপুরি নির্মূল হয়তো কঠিন, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে রাখা এখন থেকে সম্ভব হবে।
এই অভিযানের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সন্ত্রাস ও ভয়ের রাজত্ব করা পদ্মার চরে নতুন করে স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পুলিশের এই যৌথ অভিযান চরাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পুনর্গঠনের নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে।
মন্তব্য করুন