

খুলনায় নানি ও নাতি-নাতনির মরদেহ উদ্ধারকে ঘিরে রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের পর মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) রাতে নিহত দুই শিশুর বাবা শেফার আহমেদ বাদী হয়ে থানায় অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
এর আগে রোববার (১৬ নভেম্বর) রাতে খুলনা নগরীর লবণচরা থানা এলাকায় তালুকদার গলির একটি বাসায় নানি ও দুই নাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হলেন- আব্দুল হান্নানের স্ত্রী মহিদুন্নেসা (৫৫), নাতি মুস্তাকিম (৮) ও ফাতিহা (৬)। তিনজনের মরদেহ তাদের বসত ঘরের পাশে মুরগির খামারের মধ্যে পাওয়া যায়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, রোববার সকালে দুই সন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন বাবা শেফার আহমেদ। ওই দিন দুপুরে মেয়ে ফাতিহাকে দাঁতের চিকিৎসা করানোর জন্য বাড়ি থেকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান এবং সাড়ে ১২টার দিকে ফাতিহাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তিনি আবারও অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যান।
মামলার এজাহারে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে তার স্ত্রী রুবি আক্তার বাড়ির মেইন গেটে মাকে ডাকাডাকি করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। এ সময়ে শিশুদের গৃহ শিক্ষক আরাফত হোসেনও রুবি আক্তারের সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তীতে তার রুবি আক্তার ফাঁকা স্থানে থেকে হাত ঢুকিয়ে গেট খুলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন। বিষয়টি শেফার আহম্মেদ জানতে পেরে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি ঘরের দরজা এবং বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেখতে পান।
এমন অবস্থায় শেফার আহমেদ দুই সন্তানকে খুঁজতে থাকেন। পরবর্তীতে ঘরের মধ্যে মুরগির খামারে শাশুড়ি মহিতুন্নেছা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে দুই সন্তান মোস্তাকিম এবং ফাতিহা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয়দের সহায়তায় শিশুদের উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দিলে সেখানে মুহিতুন্নেছার মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট করে।
শেফার আহম্মেদ বলেন, রূপসায় একটি জায়গা নিয়ে একজনের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে। এ ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। যাকে সন্দেহ করছি তিনি জাল দলিল তৈরি করে সেটা ভোগ দখলের চেষ্টা করেছিল। বছরখানেক আগে অস্ত্রসহ রূপসা পুলিশের কাছে একবার গ্রেপ্তারও হন তিনি। বর্তমানে জামিনে আছেন।
সূত্র বলছে, হত্যাকাণ্ডের শিকার মোস্তাকিম এবং ফাতিহার মা রুবি আক্তার একেক সময় একেক রকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিচ্ছেন। তার কথাবার্তা অনেকটাই সন্দেহজনক বলে জানিয়েছে পুলিশের একাধিক সূত্র। শুধু তিনিই নন-সন্দেহের তালিকায় এই পরিবারের অনেকেই রয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, হত্যাকারীরা প্রথমে শিশু মোস্তাকিম এবং ফাতিহাকে হত্যা করে। তাদেরকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার নানি মহিতুন্নেছা বাথরুমে গোসল করছিলেন। তিনি গোসল করে বের হওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়। দুপুরের পরে যে কোনো সময় এ ৩টি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানায়, ওই পরিবারের সর্বসর্বা ছিলেন রুবি আক্তার। ভূমি অফিসে চাকরির করার সুবাদে তার নামে অনেক অর্থসম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদের দেখভাল করতেন তিনি। তার সিদ্ধান্তের বাইরে স্বামী শেফার আহমেদ কোনো কথা বলার সাহস করতেন না। দুই সন্তানের মৃত্যুতে শেফার আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়লেও রুবি আক্তার গত তিনদিনে একবারও কাঁদেননি। বরং পুলিশের একাধিক সংস্থা তার সঙ্গে হত্যার বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বার বার তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। এমনকি আশপাশের মানুষকে এড়িয়ে চলছেন। পুলিশ কথা বলতে চাইলে রুমের মধ্যে ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। মানুষের সামনে কোনো কথা বলতে চাননি।
লবণচরা থানার ওসি হাওলাদার সানওয়ার হুসাইন মাসুম বলেন, মামলা হয়েছে। ঘটনা শুনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। ঘটনাস্থলে গিয়ে মহিতুন্নেছার মরদেহ পাই এবং মোস্তাকিম ও ফাতিহাকে নিয়ে বাবা শেফার আহম্মেদ চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। সুরতহাল ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ তাদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ।
তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে তারা মামলার জন্য লবণচরা থানায় আসেন। ঘটনার পরপর আমার সকল আলামত সংগ্রহ করেছি। রক্তমাখা ইট ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সেখানে ফিঙ্গারিং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। অচিরে আমরা প্রকৃত দোষীদের আইনে মুখোমুখি করতে সক্ষম হব। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। শিশু দুটির মাথায় বিভিন্নস্থানে ইট দিয়ে আঘাত করে মারা হয়েছে।
মন্তব্য করুন