

একদিকে যেমন হানাহানি, সংঘাত ও বিদ্বেষে মানবতা বিপন্ন; অন্যদিকে শহরের নানা জায়গা থেকে আসা অনাহারী, দুস্থদের মুখে এক বেলা খাবার তুলে দিচ্ছেন পাবনা সদরের কোলাদী গ্রামের বাসিন্দা বর্তমান কানাডিয়ান প্রবাসী শমসের আলী হেলাল। এক বা দুই বছর নয়, দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এমন মহতী কাজ করে আসছেন তিনি।
পাবনা শহরে বিভিন্ন কাজে আসা প্রায় সাড়ে তিনশ অনাহারী, দুস্থ ও অসহায়দের জন্য প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুরে বিনামূল্যে খাবারের আয়োজন করেন তিনি। এদিন কাজে আসা ক্লান্ত অনাহারী দুস্থরা খুঁজে পান অন্তত একবেলা খাবারের ঠিকানা।
উদ্যোক্তারা জানান, এ ধরনের আয়োজনে অসহায়দের জন্য কিছু করতে পেরে মানসিকভাবে শান্তি পান তারা। তারা মনে করেন, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এমন উদ্যোগ হতে পারে অনেকের জন্য অনুকরণীয়।
সপ্তাহের একদিন বৃহস্পতিবার শহরের রূপকথা রোডের আইন কলেজের সামনে সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় রান্নার কর্মযজ্ঞ, দুপুর ১২টার দিকে রান্না শেষে শুরু হয় প্যাকেটিং ও দুপুর ২টার দিকে অসহায়দের মাঝে দেওয়া হয় খাবার। এদিন পাবনার প্রধান সড়ক, বড় বাজার, নিউমার্কেট, বড় ব্রিজসহ শহরের নানা বিপণি কেন্দ্রে আসা অন্ধ, পঙ্গু, শারীরিক বিকলাঙ্গসহ নানা পেশার পুরুষ ও অসহায় নারীদের মাঝে বিতরণ করা হয় এ খাবার।
আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সময় কানাডিয়ান প্রবাসী শমসের আলী হেলাল নিজ জেলাতে বেড়াতে এসে এক হোটেল মালিককে এ কাজ করতে দেখে অভিভূত হন। পরে নিজেই জড়িয়ে পড়েন এ কাজের সঙ্গে। প্রবাসী হেলালের এমন কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হন স্থানীয় কয়েকজন যুবকও। কখনো একা, আবার কখনো কয়েকজন মিলে আয়োজন করেন এদের খাবার। সবকিছু সরবরাহের পাশাপাশি সশরীরে অংশগ্রহণ করেন তারা। প্রথম দিকে ৩০ থেকে ৪০ জন দিয়ে শুরু করা এ খাবার বিতরণ কর্মসূচি এখন বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ জনে।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয়, খাবার নিতে আসা সূর্য বেগম, মমতা, কণা ও আকরামের সঙ্গে। তারা জানান, স্থানীয় যুবকদের এমন উদ্যোগে খুশি তারা। তারা বলেন, আমরা সারাদিন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। অসুস্থ হলেও কাজ করে খেতে হয় আমাদের। সপ্তাহে একদিন আমাদের জন্য তারা যে খাবারের ব্যবস্থা করে, এতে তারা অনেক খুশি। খাবার হিসেবে খিচুড়ি, ভাত ও মুরগির মাংস দেওয়া হয় তাদের।
কথা হয় পারভেজ, মেহেদী হাসান, রতন আলম, জাহেদসহ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে। তারা জানান, প্রবাসী হেলালের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেরা চালিয়ে যাচ্ছেন এই মানবিক কাজ। এতে মানসিকভাবে প্রশান্তি পান তারা। অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করতে পেরে অনেক ভালো লাগে তাদের।
তারা জানান, নানা জায়গা থেকে এখানে মানুষ আসে কাজ করতে। তাদের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে পেরে তারা যেমন খুশি হন, তেমনি নিজেরাও খুশি হন।
তারা জানান, যদি কেউ মনে করেন কয়েকজন মিলে এমন উদ্যোগ নেবেন, তবে তা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে মানুষও উপকৃতও হবে।
‘একটি ইচ্ছাই দেবে শান্তি’— এ স্লোগানকে ধারণ করা, ‘এই দেশ’ সংগঠনের উদ্যোক্তা শমসের আলী হেলাল বলেন, ছোট পরিসরে শুরু করা এ কাজের মাধ্যমে এখন প্রতি বৃহস্পতিবার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ মানুষ এখান থেকে দুপুরের খাবার খান। এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের বিষয়। যদি আরও মানুষ এ কাজে সহযোগিতা করত, তাহলে আরও বেশি আয়োজন করা যেত।
তিনি জানান, মুসলিম মরলে মুসলিম কাঁদে, হিন্দু মরলে হিন্দু কাঁদে। কিন্তু সব ধর্মের মানুষ মরলে যে কাঁদে সে মানুষ। আমরা সবাই মানুষ হতে চাই। আর মানুষ হতে গেলে ভালোবাসা বিলানো ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
তিনি বলেন, আমাদের যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, সেই সামর্থ্য অনুযায়ী প্রায় দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এ কাজ করে আসছি। আমরা যার যার জায়গা থেকে সবাই যদি সহযোগিতা করি তাহলে আমরা সবাই জিতে যাব।
তিনি জানান, মানুষের মৃত্যুর পরে সবাই আসে, কিন্তু মৃত্যুর আগে কেউ আসে না। সেই অনুভূতি থেকেই আমার এটা সৃষ্টি। আমি যুতটুকু পারি, সেটুকু দিয়েই জীবিত মানুষের পাশে দাঁড়াব। যতদিন পারবেন ঠিক ততদিন পর্যন্ত এমন মহতী কাজ করে যাবেন বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
মন্তব্য করুন