রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:১৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সার সংকটে চরম বিপাকে উত্তরাঞ্চলের আলু চাষিরা

পুরোনো ছবি
পুরোনো ছবি

গত বছর আলু চাষ করে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছিলেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার দেউলিয়া গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান। সেই ক্ষতিকে পুষিয়ে নেওয়ার আশায় এবারও আলু লাগাবেন তিনি। তবে বিপত্তি বেধেছে রাসায়নিক সার নিয়ে। স্থানীয় অনুমোদিত ডিলার পয়েন্টে ধরনা দিয়েও মিলছে না চাহিদামত সার। ফলে প্রয়োজনীয় সার না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে রোপণ কার্যক্রম।

শুধু হাবিবুর রহমানই নন, তার মতো উত্তরের ১৬ জেলার হাজার হাজার কৃষক আলু চাষের মৌসুমের শুরুতেই সার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।

কৃষকদের অভিযোগ, এক ধরনের মুনাফালোভী ডিলাররা রাতের অন্ধকারে সরকারিভাবে বরাদ্দ সার কালোবাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে ডিলার পয়েন্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও সার মিলছে না। আবার কোথাও সার মিললেও একজন কৃষককে এক বা দুই বস্তার বেশি দেওয়া হচ্ছে না, যা আলু ও শীতকালীন সবজি চাষের জন্য একেবারেই অপ্রতুল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মোট আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগেই উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৮৭ লাখ টন। চলতি মৌসুমে এই দুই বিভাগে ৩ লাখ ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৮৪ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

কৃষকদের হিসাবে, প্রতি বিঘা জমিতে আলু চাষের শুরুতেই প্রয়োজন প্রায় ২ বস্তা (১০০ কেজি) এমওপি, ১ বস্তা (৫০ কেজি) ডিএপি এবং ১ বস্তা টিএসপি। তবে এর বিপরীতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরাদ্দ দিচ্ছে বিঘাপ্রতি মাত্র ২৩ দশমিক ১৫ কেজি এমওপি, ৩৬ কেজি ডিএপি ও ১ দশমিক ৩ কেজি টিএসপি, যা কৃষকদের মতে বাস্তব চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে রাজশাহী কৃষি অঞ্চলের চার জেলায়- রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমওপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৫৫১ টন, ডিএপি ২৫ হাজার ২৮১ টন এবং টিএসপি ৯ হাজার ৫৭০ টন। আর চলতি ডিসেম্বর চার জেলায় ১৫ হাজার ৩৮০ টন এমওপি, ২৯ হাজার ৪৫০ টন ডিএপি এবং ৯ হাজার ৪৬৬ টন টিএসপি সার বরাদ্দ দেওয়ার হবে।

রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) অনুমোদিত ডিলার পয়েন্টগুলোর সামনে সকাল থেকেই কৃষকদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।

বাগমারা উপজেলায় একটি ডিলার পয়েন্টে সারের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন দেউলিয়া গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার অন্তত ১৮ বস্তা সার দরকার। সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু এখনো একটি বস্তাও পাইনি। সামনে কয়েকশ মানুষ।

একই চিত্র জয়পুরহাটের কালাই উপজেলাতেও। কৃষক নাইম ইসলাম জানান, ৫০ বস্তা সারের চাহিদার বিপরীতে ডিলাররা এক বা দুই বস্তার বেশি দিচ্ছেন না। এতে একদিকে সময় নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে জমিতে সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।

বাগমারা উপজেলার বিএডিসি ডিলার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার তিন ট্রাক সার পাওয়ার কথা, কিন্তু মাসের শুরুতে পাচ্ছি মাত্র এক ট্রাক। তাই কৃষক পাঁচ বস্তা চাইলে দিতে পারছি এক বস্তা। সার কম পেয়ে তারা পরদিন আবার সবাই আসে, তখন চাপ আরও বাড়ে।’

এদিকে, সংকটের কারণে বিকল্প উৎস থেকে অতিরিক্ত দামে কৃষকরা সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানা গেছে। রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষক লুৎফর রহমান অভিযোগ করে বলেন, সরকারি দামে সার না পেয়ে তিনি বাইরে থেকে প্রতি বস্তা টিএসপি ও ডিএপি সার ১ হাজার ৭০০ টাকায় এবং এমওপি সার ১ হাজার ৩৫০ টাকায় কিনে জমিতে আলু লাগিয়েছেন। অথচ সরকার নির্ধারিত এমওপি সারের মূল্য ১ হাজার, ডিএপি ১ হাজার ৫০ এবং টিএসপি ১ হাজার ৩৫০ টাকা।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার গ্রামের কৃষক সাকিউল ইসলাম বলেন, তাদের এলাকায় হাট-বাজারে টিএসপি সার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯৭০ টাকা, ডিএপি ১ হাজার ৪৭০ টাকা এবং এমওপি ১ হাজার ১৪০ টাকায়। তবে সবচেয়ে খারাপ বিষয়, অনেক বিক্রেতাই কোনো রসিদ দিচ্ছে না।

অন্যদিকে, সংকটের কারণে অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে প্রয়োজনের চেয়ে কম সার দিয়েই আলু রোপণ করছেন। ফলে ফলন নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলু চাষের শুরুতেই সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ না হলে গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, যার প্রভাব পড়ে পুরো মৌসুমের ফলনে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, যতটা সার দেওয়ার কথা, তার চেয়ে কম দিয়েই বীজ লাগাতে হয়েছে। এতে ফলন কম হবে এটা নিশ্চিত।

অনেক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনুমোদিত দোকান ও গুদামে না রেখে বাড়ি ও গোপন স্থানে সার মজুত করছেন। পাশাপাশি মাছচাষিরা পুকুরে ইউরিয়া ব্যবহার করায় কৃষি খাতে সারের সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

সম্প্রতি রাজশাহীর বাগমারায় উপজেলা কৃষি অফিস ও পুলিশের যৌথ অভিযানে এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার বাড়ি থেকে ৪৪৪ বস্তা অবৈধভাবে মজুত করা সার জব্দ করা হয়। পরে সেগুলো সরকারি দামে কৃষকদের মধ্যে বিক্রি করা হয়।

তবে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাবিনা বেগম বলেন, ‘সারের তেমন কোনো সংকট নেই। অনেক কৃষক প্রয়োজনের তিন থেকে চার গুণ বেশি সার ব্যবহার করছেন। যেখানে জমিতে ৩০-৩৫ কেজি সার ব্যবহার করা দরকার, সেখানে অনেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত প্রয়োগ করছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডিএপি সারে ফসফেট উপাদান থাকায় অনেক ক্ষেত্রে আলাদা করে টিএসপি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। তবু কৃষকরা ডিএপি ও এমওপি একসঙ্গে ব্যবহার করছেন।’

কৃষকদের সচেতন করতে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে জানিয়ে সাবিনা বেগম বলেন, ‘কিছু এলাকায় টিএসপি ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা আইনবিরোধী। কৃষকদের অবশ্যই ক্যাশ মেমো নিতে হবে। এতে অতিরিক্ত দাম নেওয়া ঠেকানো যাবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তারেক রহমানের অপেক্ষায় পিতৃভূমি বগুড়ার মানুষ

এলডিপি থেকে চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর পদত্যাগ

ঢাবি বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শনিবার, পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা

ভারতে কূটনৈতিক মিশনে হামলা, ঢাকার গভীর উদ্বেগ

সাহায্যের আবেদনে যত টাকা পেলেন তাসনিম জারা

নোয়াখালীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ৫

ব্লকবাস্টার সিনেমার সুপারফ্লপ রিমেক

তারেক রহমানের ফেরার দিনে পোশাক কারখানায় যে পরামর্শ দিল বিজিএমইএ

হেলিকপ্টারে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে সাতক্ষীরা-২ আসনের এমপি প্রার্থীকে

ভোটে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা চায় পুলিশ

১০

রুমিন ফারহানার আসনে যে প্রার্থী দিল বিএনপি

১১

ড্যাবের উদ্যোগে ১ হাজার রোগী পেলেন ফ্রি চিকিৎসাসেবা

১২

১১৯ আসনে প্রার্থী দিল জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট

১৩

তারেক রহমানের সংবর্ধনায় অর্ধকোটি মানুষ উপস্থিত হবে : রিজভী

১৪

সার সংকটে চরম বিপাকে উত্তরাঞ্চলের আলু চাষিরা

১৫

নীলফামারী-১ / খালেদা জিয়ার ভাগ্নের বদলে যে প্রার্থী দিল বিএনপি

১৬

ক্ষমতায় গেলে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বিশেষ ভাতা দেওয়া হবে : সালাহউদ্দিন আহমদ

১৭

এক ওভারে পাঁচ উইকেট নিয়ে ইতিহাস গড়লেন ইন্দোনেশিয়ার পেসার

১৮

বিএনপির কাছে যে আবেদন জানালেন জমিয়ত সভাপতি

১৯

যেসব খাবার থেকে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে, জানাল গবেষণা

২০
X