সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় প্রবাদ আছে ‘যার মাথায় আছে তেল, সে খায় জয় সাগরের বেল’। জয়সাগরের বেলের গুরুত্ব ও দামের বিষয়ে ইঙ্গিত করে এমন প্রবাদের প্রচলন বলে ধারণা করা হয়। রায়গঞ্জ উপজেলা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এলাকাটি বেশ প্রাচীন। এখানে বেশকিছু স্থাপনা আছে যেগুলো শত শত বছরের পুরোনো। জয়সাগর দিঘি এ রকম একটি স্থাপনা। বিশাল আকারের এই দিঘি স্থানীয় মানুষদের প্রিয় ও অবসর কাটানোর অন্যতম স্থান।
প্রায় ৫৮ একর আয়তনের এ দিঘির কথা উল্লেখ রয়েছে রায়গঞ্জ ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি নামের গ্রন্থে। এ গ্রন্থের লেখক সরকারি এমএম কলেজ যশোরের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খ ম রেজাউল করিম। গ্রন্থে জয়সাগর বিষয়ে লিখেছেন, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় বেশ কয়েকটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক দিঘির নাম জয়সাগর। জয়সাগর দিঘি নিয়ে নানারকম জনশ্রুতি আছে। কেউ বলেন, সেন বংশের শেষ রাজা অচ্যুত সেন তার কয়েক লাখ গরু ও প্রজাদের পানির কষ্ট নিবারণের জন্য জয়সাগর দিঘি খনন করেন। কেউ বলেন, ফিরোজ শাহর ছেলে বাহাদুর শাহ রাজা অচ্যুত সেনের কন্যা ভদ্রাবতীকে দেখে মুগ্ধ হন। বিয়ের প্রস্তাব দিলে রাজা অচ্যুত সেন প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় বাহাদুর শাহ ভদ্রাবতীকে অপহরণ করে নিমগাছিতে নিয়ে যান। পরবর্তীতে রাজা অচ্যুত সেন তার সৈন্যবাহিনীসহ বাহাদুর শাহকে আক্রমণ করেন। নিমগাছি প্রান্তরে ব্যাপক যুদ্ধ হয়। মুষ্টিমেয় সৈনিক থাকায় বাহাদুর শাহ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন।
রাজা অচ্যুত সেন যুদ্ধে জয়লাভ করে ভদ্রাবতীকে উদ্ধার করেন। আর এ বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে নিমগাছির কাছে রাজা অচ্যুত সেন ‘জয়সাগর’ নামে দিঘিটি খনন করান। যুদ্ধজয়ের কারণেই জয়সাগর নামে দিঘিটির নামকরণ করা হয়। আবার কেউ বলেন, রাজার কোনো ছেলেসন্তান ছিল না। এক সাধু জয় রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, তিনি যদি আধামাইল দৈর্ঘ্যের একটি দিঘি খনন করেন, তাহলে তার বৃদ্ধ বয়সেও ছেলেসন্তান জন্মাবে। সাধুর উপদেশমতো দিঘি খনন করেন। পরের বছর রাজার একটি সন্তান হয়। পুত্রের নাম রাখলেন জয় কুমার এবং তার নামানুসারে দিঘিটির নাম রাখলেন জয়সাগর।
দিঘি খনন করলে কী হবে, ১২ বছর পার হওয়ার পরও দিঘিতে পানি না আসায় রাজা হতাশ হয়ে পড়েন। এক রাতে রাজা স্বপ্নে দেখলেন, এক সাধু রাজাকে বলছে, তোমার ছেলে জয়কুমার বিয়ে করে বাড়ি ফেরার পথে দিঘিতে নেমে যদি একমুঠো মাটি তোলে তবেই দিঘিতে পানি উঠবে। অন্যথায় শতবর্ষ ধরে দিঘি খনন করলেও পানির দেখা মিলবে না।
রাজা ছেলের বিয়ের আয়োজন করলেন। বিয়ে শেষে জয়কুমার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দিঘিতে নেমে যেই এক মুঠো মাটি তুললেন, অমনি পানি উঠে দিঘি পূর্ণ হয়। তবে এটা ঠিক যে, এই দিঘির পানিতে রাজার ছেলে জয়কুমার মৃত্যুবরণ করেন। এই দিঘি ছাড়াও রাজা অচ্যুত সেন তার সেনাপতি প্রতাপের নামে ‘প্রতাপদিঘি’, ভৃত্য উদয়ের নামে ‘উদয়দিঘি’ এবং কন্যা ভদ্রাবতীর নামে ‘ভদ্রাবতীদিঘি’ খনন করান। ভদ্রাবতীদিঘি থেকে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খালটি ভদ্রাবতী নদী বা ভদাই নদী নামে পরিচিত। অতীতের জয়সাগরের জৌলুস আগের মতো আর নেই। সংস্কারের অভাবে দিঘির পাড় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দিঘি এলাকায় অবাধে গবাদিপশু চড়ানোয় এবং যত্রতত্র পশুর মলত্যাগে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। ঐতিহ্য রক্ষায় দিঘিটির সংস্কার বা উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় দর্শনার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
জয়সাগরের পূর্ব পাশে দর্শনার্থীদের বসার জন্য সিমেন্টের চেয়ার এবং টয়লেট রয়েছে। অযত্মে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা না থাকায় দিন দিন ঐতিহ্য হারাচ্ছে প্রাচীন দর্শনীয় এই স্থান। বিগত বছরগুলোতে শীত মৌসুমে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি জয়সাগরে আসত। পরিবেশ বিপর্যয় ও শিকারিদের উৎপাতে অতিথি পাখিরা আর এখানে আসে না। এক সময় হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকত, কয়েক বছর ধরে সেখানে বিরানভাব বিরাজ করছে।
জেলার উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থান হওয়ার পরও আজ পর্যন্ত দিঘিটির উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ দিঘির সংস্কার ও উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলে জয়সাগর তার হারানো জৌলুস ফিরে পেয়ে হয়ে উঠতে পারে জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
মন্তব্য করুন